আহমদ হাসান ইমরান: উপমহাদেশের জন্য গর্বের বিষয় যে ভারতীয়মূলের প্রায় যুবক ঋষি সুনাক সংকটের মুখে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। স্বভাবতই ভারতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেছে। কিন্তু পাকিস্তানও কম যায় না। তারাও ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা খুঁজে বের করেছেন যে, ঋষি সুনাক পরিবারের আদি বাড়ি ছিল বর্তমান পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের গুজরানওয়ালাতে।
এখানেই তাঁর দাদা-দাদির (ঠাকুরদা-ঠাকুমার) জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ঋষি সুনাকের বাবা-মা ছিলেন হিন্দু পাঞ্জাবি। পরে তাঁরা রুজির সন্ধানে পূর্ব আফ্রিকায় চলে গিয়েছিলেন। ঋষি সুনাকের বাবা-মা পরে আফ্রিকা থেকে ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে চলে আসেন। এখানেই ঋষির জন্ম হয়।
সব থেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ঋষির স্বচ্ছভাবে তাঁর পরিচিতি ব্রিটেনবাসীর কাছে পেশ করেছেন। কারণ, এরাই তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরণ করে নিয়েছেন। এ বিষয়ে ঋষি ভারতবাসীর কাছে উদাহরণ হতে পারেন।
আজকের পৃথিবী আইডেনটিটি ক্রাইসিস বা পরিচিতি সমস্যায় ভুগছে। আর এ থেকেই তৈরি হচ্ছে নানা ঘৃণা-বিদ্বেষ ও হেট ক্রাইম। ঋষি ব্রিটেনবাসীর কাছে গোপন করেননি যে, তাঁর পরিবার মাইগ্রেন্ট বা অভিবাসী। আরও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, খ্রিষ্টান প্রধান এই রাষ্ট্রে ঋষি স্পষ্টভাবে বলতে পেরেছেন যে, ধর্ম বিশ্বাসে তিনি একজন ‘গর্বিত হিন্দু’।
ঋষি সুনাকের হিন্দু পরিচিতি নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়াতে খুব চর্চা হচ্ছে। ব্রিটিশ সংবাদ ওয়েবসাইট ইনডিপেনডেন্ট বলেছে, ঋষি সুনাক ব্রিটেনের পহেলা হিন্দু প্রধানমন্ত্রী হবেন।
জন্মাষ্টমীর দিন ঋষি সুনাক ট্যুইটারে লিখেছিলেন, ‘আজ আমি ভক্তিবেদান্ত মানর মন্দিরে সস্ত্রীক গিয়েছিলাম। এটি একটি জনপ্রিয় হিন্দু মন্দির যেখানে লর্ড কৃষ্ণের জন্মদিন পালিত হচ্ছিল।’
ব্রিটেনের গার্ডিয়ান লিখেছে, ঋষি সুনাক একজন ধর্মপরায়ণ হিন্দু। তিনি প্রকাশ্যে নিজের ধর্ম নিয়ে কথা বলতে ইতস্তত করেন না। অবশ্য ঋষি সুনাক বলেছেন, আমি পুরোপুরি ব্রিটিশ। এখানেই হচ্ছে আমার ঘর ও দেশ। কিন্তু আমার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হচ্ছে ভারতীয়। আমার স্ত্রী ভারতীয়, আর আমি হিন্দু। এতে লুকানোর কোনও বিষয় নেই।
ঋষিকে এই বক্তব্যের জন্য অবশ্যই সাধুবাদ দিতে হয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশ আছে যেখানেই অল্পসংখ্যক কিংবা আদি অধিবাসী অল্পসংখ্যকদের নিজের পরিচিতি গোপন করতে হয়, সব সময় বলতে হয় ‘আমি কিন্তু সেক্যুলার’। তাঁকে প্রাণপনে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে হয় যে, আমি সংখ্যাগুরুদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ঘোরতর অনুসারি। সংখ্যালঘুদের ধারণা হয়ে পড়ে, এইসব না করলে সে কল্কে পাবে না। অবশ্য নিজে থেকে নয়, বহু দেশের ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের প্রবল চাপের মুখে এই ধরনের অবস্থান নিতে হয়। ঋষি সুনাকের সৌভাগ্য, তাঁর পরিবারকে এমন প্রবল চাপের মুখে পড়তে হয়নি। আর ব্রিটেনেও সংখ্যাগুরু খ্রিষ্টান শ্বেতকায় নাগরিকরা এই ধরনের কোনও দাবি তোলেননি।
ব্রিটেনে অবশ্য আগে থেকেই এই ধরনের একটা ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। ভারতীয় ও পাকিস্তানিমূলের অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হয়েছেন এবং সাফল্যের সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন। ব্রিটেনের বহু শহরে মেয়র হচ্ছেন মুসলিম। রাজধানী লন্ডনসহ আরও কয়েকটি শহরে মুসলিমরা মেয়র পদে রয়েছেন। আর অভিবাসীদের সংখ্যাও বাড়ছে, বাড়ছে মুসলিম ও হিন্দু জনসংখ্যা। কিন্তু শ্বেতকায়দের জন্মহার ব্যাপকহারে কমছে।
যাই হোক, আমাদের দেশেও যদি পরিচিতির প্রশ্নটি ব্রিটেনের মতো অবাধ হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত সুখকর। ব্রিটেনে বসবাসকারী ভারতীয় ব্রিটিশ নাগরিকরা (হিন্দু এবং মুসলিম) খোদ লন্ডনে বসে কিন্তু ক্রিকেট খেলায় ভারতকেই সমর্থন দেন। এতে ব্রিটেনের শ্বেতকায় খ্রিষ্টানরা তাঁদেরকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন না। আমরা ঋষি সুনাককে আগাম অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তাঁর সাফল্য কামনা করছি।