পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: নাগরিকত্ব পাব, ভালো থাকব, দু-বেলা দুমুঠো অন্ন জুটবে, মাথার ওপর একটা ছাদ হবে, ভালো চাকরি হবে, সন্তানরা লেখাপড়া করবে। না কোনটাই হয়নি তাদের। এরা উদ্বাস্তু। দুচোখে স্বপ্ন ছিল ভারতের নাগরিত্ব পাবে তারা, কিন্তু এখনও কিছু হয়নি। মৌলিক প্রায় সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকেই বঞ্চিত ওরা। আজও ওদের পরিচয় উদ্বাস্তু বা শরণার্থী। নাগরিত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) আশা দেখিয়েছিল তাদের, কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ।
দিল্লির ‘মজনু কা টিলা’। বাস কয়েক ঘর উদ্বাস্তু পরিবারের। অস্থায়ী তাঁবু এবং প্লাস্টারহীন ইঁটের দেওয়াল আর অ্যাসবেস্টসের ছাদের নীচে আশেপাশের দেশ থেকে অত্যাচারিত হয়ে পালিয়ে আসা হিন্দুদের আশ্রয়স্থল। রোহিনী সেক্টর ৯ এবং ১১, আদর্শ নগর এবং সিগনেচার ব্রিজের কাছে পুনর্বাসনের কলোনিতে বাস করেন এমন হিন্দুদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। এখানকার মানুষের স্বপ্ন নাগরিকত্ব। প্রায় কয়েক বছর ধরে নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় দিন গুনছে হিন্দু উদ্বাস্তু পরিবারগুলি।
জীবন সুরক্ষিত করতে অনেক আশা নিয়ে পাকিস্তান থেকে অত্যাচারিত থেকে ভারতে এসেছিল হিন্দু শরণার্থীরা। কিন্তু এখানে এসেও সুরক্ষা পাওয়া তো দূরের কথা সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা। একটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে মৌলিক অধিকার প্রয়োজন হয়, তাও তাদের জীবনে জোটেনি।
দিল্লির দিল্লির ‘মজনু কা টিলায়’ এই ভাবেই পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু শরণার্থীরা বঞ্চিত সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে। বাড়িতে নেই জীবন ধারণের ন্যূনতম পরিষেবা। তাঁবু ও প্লাস্টারহীন বাড়িতে নেই জল ও বিদ্যুতের সুবিধা।
প্রায় একই অবস্থায় আফগান হিন্দু ও শিখ শরনার্থীরা। আফগানিস্তানে সংখ্যালঘু হামলার শিকার হয়ে তারা ভারতে এসেছিল একটু আশ্রয়, নিরাপত্তার খোঁজে। নিরাপত্তা জোটেনি, প্রতিদিন বেঁচে থাকাটাই এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই রকম একজনের নাম রাধা সোলাঙ্কি। যিনি পাকিস্তান থেকে ভারতে আসেন মাত্র ৯ বছর বয়সে। রাধার বক্তব্য, তাদের আশা, স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। নাগরিকত্ব পাওয়ার আশা ছিল, কিন্তু এখন নেই। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এখন আটকে রয়েছে। কি হবে জানি না।
রাধা সোলাঙ্কি আরও জানিয়েছেন, আমরা এখনও কোনও সাহায্য পায়নি। আমাদের না আছে পানীয় জলের বন্দোবস্ত, না আছে বিদ্যুতের সুবিধা। প্রাত্যহিক চাহিদাগুলি মেটানোই দুর্বিষহ হয়ে গেছে আমাদের। এক করুণ পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছি আমরা। আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। আমাদের জন্য কারুর কোনও সহানুভূতি নেই। কারণ আমাদের জন্য সহানুভূতি দেখানোর প্রয়োজন কেউ মনে করে না। আমাদের অবস্থা খাঁচাবন্দী পাখির মতো। মরার মতো করে বেঁচে আছি।
সোলাঙ্কি আরও জানিয়েছেন, করোনার কারণে আমাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছে। কোনও রোজগার নেই। ছেলে-মেয়েদেরও টাকার অভাবে স্কুলে পাঠাতে পারি না। তাদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। আর অনলাইন ক্লাস করানো আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
সোলাঙ্কি আরও জানান, করোনায় দেশব্যাপি লকডাউনের আমাদের জীবনে একদম বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তখনই সন্তানদের স্কুল ছাড়াতে বাধ্য হই। এই উদ্বাস্তু শিবিরে একমাত্র আমার পরিবারে আমার স্বামীর মোবাইল একটি ফোন আছে। কিভাবে করাব অন লাইন ক্লাস।
৩০ বছরের গঙ্গা জানিয়েছেন, তার স্বামী একটি মোবাইল কভারের দোকান চালিয়ে রোজগার করেন। পরিবারের একমাত্র সামান্য উপার্জনকারী। এই অবস্থায় আমাদের কথা শোনার কোনও লোক নেই। আমরা চাই কেউতো আমাদের সাহায্য করুক, তবে অন্তত তারা আমাদের হয়তো নাগরিকত্ব ও চাকরি দেবে।
উল্লেখ্য, নাগরিক সংশোধনী আইন নিয়ে সোচ্চার হয় কেন্দ্র সরকার। ২০২২ সালের মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে একটি জনসভাও করেন। সেখানেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শাহ জানিয়েছিলেন, করোনা অতিমারির প্রাদুর্ভাব কমে গেলেই নাগরিক সংশোধনী আইন কার্যকর করা হবে।
উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে মানবাধিকার কর্মী কবিতা কৃষ্ণান বলেছেন যে, শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রয়োজন নেই।
কবিতা কৃষ্ণান প্রশ্ন তোলেন, নাগরিকত্ব আইন ছাড়াই যদি উদ্বাস্তুদের নাগরিত্ব দেওয়া যায়, তাহলে কেন সেটি করছে না সরকার? কৃষ্ণান আরও বলেন, আগে সরকার তাদের বেঁচে থাকার জন্য মৌলিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করুক। যেটা তাদের প্রাপ্য।
আফগানিস্তানে সংখ্যালঘুদের হাতে অত্যাচারিত হয়ে ভারতে পালিয়ে আসা আফগান ও শিখদের নিয়ে একইভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারতীয় ওয়ার্ল্ড ফোরাম। সংশ্লিষ্ট সংস্থার সভাপতি পুনীত চাঁদহক জানিয়েছেন, আসলে আমাদের দেশে এদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এইভাবে হয়তো তারা একদিন শেষ হয়ে যাবে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনটি বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং পার্সি সম্প্রদায়ের নির্যাতিত অমুসলিমদের ভারতীয় নাগরিকত্ব প্রদান করবে এটাই বলা হয় কেন্দ্রের তরফে। সংসদে পাস হয়েছিল, কিন্তু এখনও নিয়ম প্রণয়ন করা হয়নি বলে তা কার্যকর করা যায়নি।