আহমদ হাসান ইমরান: শেষ পর্যন্ত ৪ রাজ্যে ভোটের যে ফলাফল সামনে এল তা একমাত্র গোদি মিডিয়া ছাড়া আর কারোই বোধহয় প্রত্যাশিত ছিল না। ‘সেক্যুলার’ দল বলে পরিচিত রাজনৈতিক পার্টিগুলিও বড় আশা করে বসেছিল, রাজ্যগুলির ফলাফল ২০২৪-এ মোদিকে গদিচ্যুত করতে সাহায্য করবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের আশা পূরণ হয়নি। সেমিফাইনালে এই সেক্যুলার দলগুলি হেরে গেছে। তবে খানিকটা বাঁচোয়া, সেমিতে হারলেও তারা কিন্তু এখনও টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায়নি। ২০২৪-এ তারা বিজেপি ও আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়ার সুযোগ পাবে।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ২০২৪-এ কী প্রকৃতই বিজেপি বিরোধী দলগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে পারবে? ইন্ডিয়া জোট কী ইন্ডিয়ার মানুষের মন জয় করে বিজেপি-আরএসএস-এর মোকাবিলা করতে পারবে? ইন্ডিয়া জোট কী সত্যি প্রকৃত অর্থেই জোটবদ্ধ হতে পারবে? এই প্রশ্নগুলি এখন মানুষকে ভাবাচ্ছে।
এই নির্বাচনে কয়েকটি রাজ্যে দেখা গেল, ইন্ডিয়া জোটের শরীকরা জোটবদ্ধ হলে বিজেপি এত আসনে জয়ী হত না। উদাহরণস্বরূপ রাজস্থান ও মধ্য প্রদেশের কথা বলা যেতে পারে। রাজস্থান সম্পর্কে ভোট বিশেষজ্ঞ যোগেন্দ্র যাদব বলেছেন, যাদের নিয়ে ইন্ডিয়া জোট করা হয়েছে, তারা যদি এক হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ত, তাহলে রাজস্থানে কম করে ৩২টি আসন বেশি পাওয়া যেত। রাজস্থানে সমাজবাদী পার্টি, সিপিআই, সিপিএম, আরএলডি ইত্যকার দলগুলি বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে আলাদা আলাদা ভাবে প্রার্থী দিয়েছে। ভোটের অংকে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের প্রাপ্ত ভোট যোগ হলে ৩২টি আসন হয়তো বিজেপির পাতে পড়ত না।
এ সম্পর্কে চুলচেরা বিশ্লেষণ পরে করা যাবে। এখন কংগ্রেসের এই ফলাফল কেন, তা নিয়ে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে। রাহুলের ভারত জোড় যাত্রা, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের তীক্ষ্ণ বক্তব্য, কর্নাটকে বিজেপির পরাজয়- এইসব ঘটনা থেকে মনে হচ্ছিল, এবার হয়তো বিজেপির বিরুদ্ধে ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর কাজ করবে। মানুষ তাদের অপশাসনের হাত থেকে মুক্তি চায়। বিশেষ করে কংগ্রেস, তৃণমূল, ডিএমকে প্রভৃতি বিরোধী দলগুলির সমন্বয়ে ইন্ডিয়া জোটের গঠন বেশকিছুটা আশার আলো দেখিয়েছিল।
তাহলে এই ধরনের ফলাফল কেন হল? কোনও দলই কিন্তু ছাপ্পা ভোট, ইভিএম-এ কারচুপি জাতীয় প্রশ্ন তোলেনি। প্রত্যেককেই এটিকে জনগণের স্বাভাবিক মতদান হিসেবে ধরে নিয়েছে।
আবারও সেই প্রশ্ন, যে তিন রাজ্যে বিজেপি জিতেছে তার মধ্যে দু’টি রাজ্যে ছিল কংগ্রেসের সরকার (ছত্তিশগড় ও রাজস্থান)। তাহলে সুবিধাজনক স্থানে থেকেও ওই দুই রাজ্যে কংগ্রেস পরাজিত হল কেন? বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এ জন্য কেন্দ্রে কংগ্রেস দলের গৃহীত নীতি ও আচরণের দিকে আঙুল তুলতে হবে। ক্ষমতায় এলে বা শক্তিধর হলেই কংগ্রেস ভুলে যায় যে তারা এখন আর ১৯৫০ বা ১৯৬০ সালের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী সেই আদি কংগ্রেস নয়। কংগ্রেস নেতারা মানুষের কথা শুনতে চান না। তাঁদের নিজেদের সিদ্ধান্তই তারা দল ও দেশের উপর চাপিয়ে দেন। সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো নীতি তারা এখনও অনুসরণ করেন না। ‘বড় দল’, ‘শাসক দল’ এই ধরনের মানসিকতা কংগ্রেসকে পেয়ে বসেছে। অন্যান্য দলের তুলনায় কংগ্রেসে বহু নেতা-নেত্রী রয়েছেন। অনেকেই যথেষ্ট যোগ্য। কিন্তু তাদের মতামত নেওয়ার কোনও ‘সিস্টেম’ কংগ্রেসে নেই।
ফলে নেতৃত্বের সঙ্গে সাধারণ মানুষ কিংবা জমিনে নেমে কাজ করা কার্যকর্তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর কংগ্রেস ভুলে যায় যে তারা এখন অনেক অবক্ষয় যুক্ত একটি দল। কাজেই অন্য রাজনৈতিক দল কিংবা আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে হবে। ভিন্ন দলগুলির সঙ্গে জমিদার কায়দায় আচরণ করা চলবে না। তৃণমূল, ডিএমকে, এনসিপি প্রভৃতি দলের সঙ্গে তাদের সমমর্যাদা দিয়ে আচরণ করতে হবে। কিন্তু কংগ্রেসে তা দেখা যায় না। তাই কেন্দ্রে যদি ইন্ডিয়া জোট নিয়ে উৎসাহ দেখা যায়, কিন্তু তা নিচের দিকে রাজ্য পর্যায়ে সঞ্চারিত হয় না। ফলে কর্মীরা অবশ্যই খানিকটা বিমূঢ় হয়ে পড়েন।
মুখে না বললেও কংগ্রেস দল ইন্ডিয়া জোটের শরীকদের কাছে যে নিজের নানা কাজকর্মে এই ইঙ্গিত দিয়েছে যে, ইন্ডিয়া জোটের নেতৃত্ব দেবে তারাই। এছাড়া শুধু পাঁচতারা হোটেলে নেতৃবৃ¨ের সঙ্গে কাঁধেকাঁধ মেলালেই জোট ঐক্য তৈরি হয় না। রাজ্য বা নীচু পর্যায়েও জোটের শরীকদের মধ্যে যোগাযোগ ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই শরীক বিভিন্ন দলের সঙ্গে রাজ্য নির্বাচন নিয়ে তাদের কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু জোটেরই কেউ কেউ বলেছেন, বিভিন্ন দল ইন্ডিয়া জোট গড়বে কেবলমাত্র ২০২৪-এর নির্বাচনের জন্য। রাজ্যে তারা আলাদা।
এই ধরনের মনোভাব ‘ইন্ডিয়া’ জোটের জন্য খুব বেশি ফলপ্রসূ হবে না বা হচ্ছে না, তা বলাই বাহুল্য।কিন্তু ইন্ডিয়া জোটের অন্যতম নেতা ওমর আবদুল্লাহ এবং রাজ্যে কুণাল ঘোষ বলেছেন, ৫ রাজ্যের নির্বাচনের কোনও প্রভাব ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পড়বে না। লোকসভা নির্বাচনে ইন্ডিয়া জোট বিলকুল ভালো ফল করবে। তবে এই ফলাফল যে গৈরিক দলটিকে উজ্জীবিত করবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আর একটি জিনিস লক্ষ্য করা গেছে। বিজেপি, আরএসএস-রা নির্বাচনে সাম্প্রদায়িকতা আমদানির জন্য বহু চেষ্টা করলেও মানুষের ভোট পেতে সবসময় সাম্প্রদায়িক অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে রাজস্থানে তাঁর ভাষণে কট্টর সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের চেষ্টা করেছেন। রাজস্থানে হিন্দু দরজির হত্যাকাণ্ডকে তিনি প্রচারে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস রাজস্থানে কুপোকাত হল। রাজস্থানে এবং মধ্যপ্রদেশেও সাম্প্রদায়িক প্রচারণা খুব বেশি কাজে আসেনি। তা সে বিজেপিরই হোক কিংবা কংগ্রেসের কমল নাথের।
তাই বিজেপিকে বুঝতে হবে সাম্প্রদায়িকতাকে তুঙ্গে তুলে, দেশের পরিবেশকে বিষাক্ত করে ভোট টানার চেষ্টার সবসময় খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বার বার বিজেপির নেতারা তাকেই হাতিয়ার করে। তবে এই নির্বাচনের ফলাফল ইন্ডিয়া জোটকে সতর্ক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তারা নিজেদের ভুল-ত্রুটিগুলি সামলে এগোতে পারে। নইলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনে জয় লাভের পর তাঁর ভাষণে সঠিক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি কংগ্রেসকে বলেছেন, ‘এখনই শুধরে যান, নাহলে জনতা আপনাদের বেছে বেছে সাফ করে দেবে।’ অবশ্য কে কাকে সাফ করবে তার জন্য চার-পাঁচ মাস অপেক্ষা করতে হবে।