পুবের কলম প্রতিবেদক: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাগিংয়ের ঘটনায় ছাত্রমৃত্যু ঘটলেও টনক নড়েনি বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এবার সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল হলদিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে (এইচআইটি)। র্যাগিংয়ের ঘটনায় বাধা দিতে গেলে ওই কলেজের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক ছাত্রকে ব্যাপক মারধর করে কয়েকজন পড়ুয়া। আক্রান্ত ছাত্রকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসার জন্য প্রথমে স্থানীয় ডা. বি সি রায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে ওই ছাত্রকে কলকাতায় এনে এসএসকেএম হাসপাতালের ট্রমা কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করা হয়।
পরিবার ও কলেজ সূত্রে জানা গিয়েছে, ছাত্রের নাম নাসিম পাহলোয়ান। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র তিনি। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাড়ি থেকে ফিরে ২৮ নভেম্বর কলেজে যান নাসিম। কলেজের বাইরের এক ভাড়া মেসে থাকেন তিনি। আর তার সঙ্গে থাকেন ইজাজ নামে আরও এক ছাত্র। ইজাজের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের সবং এলাকায়। সবং এলাকার আরও এক ছাত্র সে’ আফতাব হোসেন ওই কলেজের এগ্রি-মেকানিক্যাল বিভাগের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া।
জানা গিয়েছে, বিগত কয়েকদিন ধরে আফতাবকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করছিল তার সিনিয়র কয়েকজন। অভিযুক্তদের মধ্যে বিবেক কুমার ও আয়ুষ ঝা অন্যতম। নিগৃহীত ছাত্র আফতাব জানান, আমাকে চাপ দিতো। তাদের অ্যাসাইনমেন্ট প্রস্তুত করে দিতে। আমার প্রশ্ন, নিজের পড়াশোনা ছেড়ে তাদের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে দেবো কেন? বিষয়টি ওদের বলতে গেলে বিভিন্নভাবে র্যাগিংয়ের মাত্রা বাড়াতে থাকে তৃতীয়বর্ষ এবং চতুর্থ বর্ষের কয়েকজন পড়ুয়া। মারধরের হুমকিও দিতে থাকে। এই বিষয়টি সহ্য করতে না পেরে আমারই এলাকার এক সিনিয়র ছাত্রের দ্বারস্থ হলাম। ইজাজ নামে ওই সিনিয়র ছাত্র মেসে ছিলেন না। তাই তাঁর রুমমেট নাসিম পাহলোয়ানের সহযোগিতা চাই আফতাব। অভিযুক্ত ওই ছাত্রদের র্যাগিংয়ের বিভিন্ন ঘটনার কথা নাসিমকে জানাই। এই কথা শুনে নাসিম বুধবার বিকেলে কলেজে অভিযুক্তদের কাছে আফতাবের বিষয়ে অনুরোধ জানাতে যান।
কলেজের খেলার মাঠের পাশে ছাত্রছাত্রীদের সামনে বিষয়টি তুলতেই পিছন থেকে কয়েকজন প্রথমে নাসিমের উপর চড়াও হয়। রুমে গেলে কয়েকজন এসে ব্যাট-উইকেট দিয়ে আঘাত করতে থাকে। নাসিম বলতে থাকে, আমাকে মারছ কেন, আমি তো আফতাবের উপর র্যাগিং যাতে না করা হয়, তার অনুরোধ জানাতে এসেছিলাম। তারপর আবারও চড়-থাপ্পড়, মাথায় আঘাত। সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যান নাসিম। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন। এর পরও আবার কয়েকজন এসে তার উপর চড়াও হয়। হাত ভেঙে যায়, মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে নাসিমের। তারপরই জ্ঞান হারান নাসিম। সেই সময় প্রাণ বাঁচাতে নাসিমকে ছেড়ে দিয়ে পালাতে বাধ্য হই বলে জানান প্রথম বর্ষের পড়ুয়া আফতাব।
এই ঘটনার পর সহপাঠীদের কয়েকজন এবং কলেজের কর্মীরা হলদিয়ার আইসিএআরই ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসার্চ অ্যান্ড ডা. বিধানচন্দ্র রায় হাসপাতালে নিয়ে যান। সে’ানে অবস্থার অবনতি হলে নাসিমকে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। বুধবার রাতেই নাসিমকে এসএসকেএম-এর ট্রমা কেয়ারে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে এসএসকেএম-এর এই বিভাগে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন নাসিম।
এই বিষয়ে নাসিমের আব্বা সায়েদ পাহলোয়ান ‘পুবের কলম’কে বলেন, আমরা অভিযুক্তদের শাস্তি চাই। অন্য পড়ুয়ারা যাতে র্যাগিংয়ের শিকার না হন, তার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানাই। তাঁর প্রশ্ন, আমার ছেলের যা ক্ষতি হয়েছে, তার খেসারত কে দেবে? র্যাগিংয়ে শিকার ওই ছাত্রের বক্তব্য, প্রতিনিয়ত কলেজে এভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে পড়াশোনা করব কীভাবে। এর বিরুদ্ধে কলেজ কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
র্যাগিংয়ের বিষয়ে এইচআইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ থেকে বলা হয়, এই ঘটনায় কলেজের অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। অভিযুক্ত দুই ছাত্রকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কলেজ কর্তৃপক্ষই স্থানীয় থানায় এই নিয়ে অভিযোগ জানিয়েছে। তবে এই বিষয়ে কলেজের রেজিস্ট্রার, প্রিন্সিপালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা কিছু বলতে অস্বীকার করেন। থানায় কোনও অভিযোগ জানানো হয়েছে কি না, এই বিষয়ে হলদিয়া পুলিশ স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ ‘পুবের কলম’কে জানায়, এইচআইটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তরফে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কোনও অভিযোগ হলদিয়া থানায় জমা পড়েনি। আক্রান্ত ছাত্রের আব্বা অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে হাসপাতালে ব্যস্ত থাকার কারণে এ’নও থানায় লিখিত অভিযোগ করেননি বলে জানান নাসিমের পিতা সায়েদ পাহলোয়ান।
হলদিয়ার এইচআইটি কলেজের চেয়ারম্যান হলেন সিপিএম-এর এক সময়ের দাপুটে নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠ। তাঁর সঙ্গে এই বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমিই ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ঠিকই। তবে ঘটনার কথা আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবো। কিছু হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।