পুবের কলম ওয়েব ডেস্ক: দীর্ঘ লড়াইয়ের পর অবশেষে বিরাট স্বস্তি। অন্ধকূপে ১৭দিন কাটানোর পর ‘আলো’ দেখলেন ৪১জন শ্রমিক। আলো দেখল আসমুদ্র হিমাচল। কারণ, সমগ্র দেশবাসীও তো একবুক উৎকণ্ঠা নিয়ে নজর রেখে বসেছিল এই উদ্ধার অভিযানের দিকে। সেই অসীম উদ্বেগের অবসান হল মঙ্গলবার।
এককথায়— রুদ্ধশ্বাস লড়াই। মঙ্গলবার সকালে ‘ভিক্ট্রি’ চিহ্ন দেখিয়ে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর জওয়ানরা অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে সুড়ঙ্গের ভিতরে ঢুকতেই বার্তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। স্পষ্ট হয়ে যায়, সিল্কইয়ারা সুড়ঙ্গে আটকে থাকা শ্রমিকদের বের করে আনা শুধুই সময়ের অপেক্ষা। তারপর থেকে শুরু হয়ে যায় কাউন্টডাউন। টিভি চ্যানেলগুলিও ব্রেকিং নিউজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাংবাদিকদের মধ্যে তুমুল ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়, যা এতদিন কিছুটা ঝিমিয়ে ছিল।
আজই শ্রমিকদের সুড়ঙ্গ থেকে বের করে আনা হবে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সবাই নিমেশে চাঙ্গা। উদ্ধারে দীর্ঘ সময় নিয়ে হতাশ হওয়া শ্রমিকদের পরিবারের সদস্যরাও নতুন আশায় বুক বেঁধে সুড়ঙ্গের সামনে একে একে ভিড় করতে শুরু করে। তারপর সময় যত গড়িয়েছে ইতিহাস গড়ার এক একটি ধাপও পার করে গিয়েছেন উদ্ধারকারীরা।
শ্রমিকদের উদ্ধারের ক্ষেত্রে শেষ ১০-১২ মিটার খনন করতে কার্যত নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল উদ্ধারকারী টিমের। এই পর্যায়ে এসেই একাধিকবার ভেঙে যায় আমেরিকার তৈরি ড্রিল মেশিন অগার। কার্যত তীরে এসে তরী ডোবে। আর মেশিনে ভরসা না করে শাবল, গাঁইতি হাতে নিয়ে খননের সেই বহু পুরনো পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়াই শ্রেয় মনে করেন উদ্ধারকারীরা। নামানো হয় ইন্ডিয়ান আর্মিকে।
পাশাপাশি, আরও একটি বিকল্প ব্যবস্থার প্রক্রিয়াও জারি রাখা হয়। পাহাড়ের উপর থেকে উলম্বভাবে সুড়ঙ্গে প্রবেশের চেষ্টা হয়। যন্ত্র নির্ভরতা কাটিয়ে সোমবার সন্ধ্যা থেকেই ‘ম্যানুয়াল খনন’ (হাত লাগিয়ে খোঁড়া) শুরু হয়। অবলম্বন করা হয় ‘র্যাট হোল’ পদ্ধতি। সাধারণত খনি থেকে কয়লা তুলতে এই খনন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সেইমতো এই খননে বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনে সোমবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ সুড়ঙ্গে ‘ইঁদুরের মতো গর্ত খোঁড়া’র কাজ শুরু হয়। তাতেই মেলে বড় সাফল্য।
২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ১২ মিটার ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলেন তাঁরা। সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকদের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান তাঁরা। বলা ভালো, সাফল্যের একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান তাঁরা। কিন্তু, এখানেও যেন অনেকটা সেই ‘তীরে এসে তরী ডোবা’র পুরনো গল্প। সেখানে খননকাজে একটি পাইপ নতুন করে বাধা তৈরি করে। সাফল্য যেন ধরা দিয়েও ফস্কে যাচ্ছে। সেই পাইপকেও ফের কেটে সরাতে হয় উদ্ধারকারী দলকে। তাতে আরও এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। প্রথম থেকেই সুড়ঙ্গের খোঁড়া জায়গায় বসানো হয়ে আসছে লোহার পাইপ। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ৮০০ মিলিমিটার প্রশস্ত পাইপ মঙ্গলবার ৫টার আগেই প্রায় ৫৬ মিটার বসানো শেষ হয়ে যায়। এরপর থেকে ব্যাটন হাতে তুলে নেয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। ১-২ মিটার খুঁড়েই তারা পৌঁছে যায় শ্রমিকদের মুখোমুখি। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। সুড়ঙ্গে আটক শ্রমিকরা নিজের নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তাদের চোখে জল। চোখে জল সেখানে পৌঁছানো এনডিআরএফ জওয়ানদের চোখেও। তাঁরাও তো সহ নাগরিকদের উদ্ধার করতে নিজেদের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন। তাঁরাও হয়তো তাঁদের পরিবারের হাতে হাত রেখে বিদায় নেওয়ার সময় চোয়াল শক্ত করে বলে এসেছিলেন— নাও ফিরতে পারেন, ৪১জনের জীবন বাঁচানোই এখন তাঁদের জীবন-পণ। আজ তাঁদেরও স্বপ্ন সফল। কঠিন লড়াইয়ের তাঁরা বিজয়ী যোদ্ধা।
এরপর আর সময় নষ্ট নয়। চাকা লাগানো স্ট্রেচারে শুইয়ে দড়ি দিয়ে পাইপ-পথ ধরে একে একে বের করে আনা হয় শ্রমিকদের। বাইরে তখন রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষায় অপেক্ষারত তাঁদের পরিজনরা। ১৭দিনের চরম উৎকণ্ঠার পর প্রিয়জনকে প্রথমবার দেখতে পাওয়ায় তাঁদেরও চোখের জল বাঁধ মানেনি।
এমনিতেই সুড়ঙ্গের মধ্যেই শ্রমিকদের জন্য ৮ শয্যার অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি রাখা ছিল। সেখানে ছিল চিকিৎসকদের একটি দলও। সুড়ঙ্গের বাইরেই রাখা ছিল ৪১টি অ্যাম্বুলেন্স। বাইরে আসার পর শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে অ্যাম্বুলেন্সে চিনিয়ালিসাউর হাসপাতালে পাঠানোর পরিকল্পনা—সবটা আগে থেকেই করা ছিল। হাসপাতালে শ্রমিকদের জন্য ৪১টি শয্যার একটি বিশেষ ওয়ার্ড প্রস্তুত রাখা ছিল। প্রস্তুত রাখা হয়েছিল ঋষিকেশ এইমসও। তৈরি রাখা হয়েছিল চিনুক কপ্টারও। কোনও শ্রমিকের শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক হলে তাঁকে দ্রুত কপ্টারে করে এইমসে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই বন্দোবস্ত ছিল।
মঙ্গলবার দুপুরে সুড়ঙ্গের বাইরে পৌঁছান উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্করসিংহ ধামী। তিনি গোটা পরিস্থিতি তদারক করেন। শ্রমিকদের স্বাগত জানাতে ঘটনাস্থলে রাখা হয়েছিল ৪১টি ফুলের মালা।