আহমদ হাসান ইমরান: ৫৭টি আরব এবং মুসলিম দেশের শীর্ষনেতারা বহুদিন বাদ মিলিত হয়েছিলেন রিয়াধে। প্রেক্ষাপট ছিল, অবরুদ্ধ গাজায় যেভাবে ইসরাইল বাড়িঘর, হাসপাতাল, মসজিদ, চার্চ এবং জীবন ধারণের সমস্ত উপকরণ ধূলিসাৎ করে যাচ্ছে, সেই সম্পর্কে আলোচনা।
১৯৪৮ সালের পর উচ্ছেদকৃত যেসব ফিলিস্তিনি গাজায় বসবাস করছেন, তাঁদের উপর নৃশংস আক্রমণের কথা এখন সারা পৃথিবী জানে। মনে হয়, পশ্চিমা শাসকরা এইসব টিভির পর্দায় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেখে খুবই আমোদ পাচ্ছেন। আশা ছিল, এতগুলি মুসলিম দেশের শীর্ষনেতাদের বৈঠকে এমন কোনও সিদ্ধান্ত হবে যাতে গাজার ২৩ লক্ষ মানুষ খানিকটা হলেও স্বস্তি পাবে। আর ইসরাইল পাবে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি যে, ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষের উপর বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও মারাত্মক বোমাবর্ষণ করে যে অবাধ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ তারা চালাচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ হবে। না হলে ইসরাইলকে ফল ভোগ করতে হবে।
কিন্তু তাবড় তাবড় মুসলিম নেতাদের এই বৈঠক ঘাতক ইসরাইলকে আরও মজবুতি দিয়েছে। রিয়াধে মুসলিম নেতারা অসহায়ভাবে যেসব আলোচনা করেছেন, যে ঘোষণাপত্র জারি করেছেন তাতে ইসরাইলের সেনাপ্রধান, রাজনীতিবিদ এবং ইসরাইলের নীতি-নির্ধারকরা মনে হয় বেজায় খুশি হয়েছেন। কারণ, মুসলিম বিশ্বের এই তাবড় তাবড় নেতারা বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
অনেকে বলছেন, এর থেকে সউদির রাজধানী রিয়াধে এই ‘ইসলামি সম্মেলন’ না করলেই বরং ভালো হত। মুসলিম বিশ্বের প্রখ্যাত নেতারা এতে উপস্থিত ছিলেন। অনেক মাথা ঘামানোর পর সম্মেলন থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এরা সকলেই ‘অশ্বডিম্ব’ পয়দা করেছেন। প্রস্তাব এসেছিল অনেকগুলি। যেমন, ইসরাইলে তেল সরবরাহকে বানচাল করতে হবে। আসলে কিন্তু এই উদ্দেশে কোনও পদক্ষেপের ঘোষণা মুসলিম দেশগুলি করতে পারেনি। ইরান প্রস্তাব রেখেছিল, ইসরাইলি সেনাবাহিনী ও ইসরাইলকে সন্ত্রাসী সংগঠন ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করা হোক। কিন্তু না, ইসরাইল ‘ছোট হবে’ এই ধরনের কোনও প্রস্তাব তাঁরা গ্রহণ করতে পারেননি। পাকিস্তান শর্ত ছাড়াই অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধের ডাক দিয়েছিল।
না, ৫৭টি দেশ একযোগে এই প্রস্তাবটিতেও সহমত পোষণ করেনি। ফলে ঘোষণাপত্রে এগুলি রাখা হয়নি। তবে কিছু গরম গরম ভাষণ অবশ্যই হয়েছে।
সারা দুনিয়া বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব আশা করেছিল, আহা, তাদের নেতা, রাজা-বাদশাহ, স্বৈরাচারী সামরিক শাসকরা যখন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন তখন হয়তো গাজায় শিশু, নারীদের লাগাতার হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে। ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানের বার্তা যাবে। গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষরা আশার আলো দেখবেন ইত্যাদি আরও কত কী। কিন্তু আদতে এই সম্মেলনে এসে দেখতে পাওয়া গেছে, আরব রাষ্ট্রগুলির কেউই ইসরাইলকে চটাতে রাজি নয়।
রাজি নয় ফোঁস করতেও। তারা কেউই ইসরাইলকে কোনও হুঁশিয়ারি দিতে পারেনি। পারেনি গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের ৫০ লক্ষ নারী-পুরুষ, শিশুর জন্য কোনও ভরসার বাণী দিতে। তবে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান ও ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি এবং কাতারের আমীর কিন্তু রাজা-মহারাজাদের থেকে আলাদা বক্তব্য রেখেছেন। আর এটাও জানা দরকার, কারা ইসরাইল সামান্য বিপদে পড়তে পারে, সামান্য সংযত হতে পারে এই ধরনের প্রস্তাবকে গ্রহণ করতে রাজি হননি। তাঁরাও মুখে না বললেও বুঝিয়ে দিয়েছেন, মুসলিম নারী, পুরুষ, শিশুদের ঘাতক নেতানিয়াহুর প্রতি তাঁদের সমর্থন।
কোন মুসলিম দেশগুলি যায়নবাদী, খুনি ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাসে বাধা দিয়েছিল? এ কথা এখন সকলেই জানতে চাইছে। ইসলামপন্থী এই দেশগুলির নেতৃত্ব দিয়েছে সউদি আরব। মুহাম্মদ বিন সলমন এখন ইসরাইলের ‘পরম মিত্র’। ইসরাইল সম্ভবত তাঁকে বুঝিয়েছে, যদি শাহী গদি রাখতে চাও তবে ইসরাইলি সেনা ও মোসাদ-এর সহায়তা তোমাদের বিশেষ প্রয়োজন। মোসাদ সবসময় আরবের এই রাজা-বাদশাহদের ভয় দেখায়, আমরা না থাকলে তোমরা ইসলামপন্থীদের বিদ্রোহে ক্ষমতা হারাবে।
সউদি আরব ছাড়া আর যে দেশগুলি ইসরাইলের সুরক্ষায় খাড়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে রয়েছে সংযুক্ত আমীরশাহী এবং বাহরাইন। এই দেশগুলি আল-আক্সা দখলকারী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে ইতিমধ্যেই তেল আবিবের সঙ্গে চুক্তি করে বসে আছে। সউদি আরবের পর ইসরাইল প্রেমিক হিসেবে উঠে এসেছে সংযুক্ত আমীরশাহী (ইউএই), মরক্কো, বাহরাইন, সুদান, মৌরিতানিয়া, জীবুতি, জর্ডন এবং এল সিসির কবজাধীন রাষ্ট্র মিশর। আরব বিশ্বের সাধারণ মানুষ বলছেন, সত্যিকারের অর্থেই এই সম্মেলন কোনও কিছু হাসিল করতে পারেনি।
না পেরেছে যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংসলীলা বন্ধ করতে আর না পেরেছে অবরুদ্ধ গাজা ও পশ্চিম তীরের অধিবাসীদের জন্য কোনও মানবিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতে। আসলে আরব রাষ্ট্রগুলি এখন আমেরিকা ও ইসরাইলের দয়াতেই বেঁচে আছে। অর্থাৎ কি না তাদের শাসকরা ইসরাইলের নীল নকশার কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে রয়েছে। এই সম্মেলন তারা করেছিল কারণ, কোনও প্রচেষ্টা না করলে দেশের সাধারণ নাগরিক ও ক্ষুব্ধ আলেমদের রোষের মুখে তাদের গদি রক্ষা মুশকিল হবে।
সকলেই জানেন, ইসরাইল বেঁচে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ, রাজনৈতিক সমর্থন এবং অস্ত্র জোগানের দ্বারা। আর আরব রাষ্ট্রগুলির শাসকরা ক্ষমতায় আছে মার্কিন এবং ইসরাইলের গোপন সমর্থনের জোরে।
তাই ফিলিস্তিনকে যদি স্বাধীনতা ও আজাদির ঝান্ডা নিয়ে বলতে হয়, ‘ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘আল কুদস মুক্ত করো’, আজাদ কর ‘মসজিদুল আক্সা’, ফিরিয়ে দাও আমাদের জমিন আমাদেরকেই, তাহলে তা তাদের করতে হবে নিজের ঈমানী চেতনা ও সংগ্রামের দ্বারা। আরব শাসকরা হামাস বা অন্য কোনও গণতান্ত্রিক উত্থানকে ভয় করে।
তারা ইসরাইল ও আমেরিকাকে নিজেদের রক্ষাকর্তা ও ‘মিত্র’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এখন মুসলিম জনগণকেই তাদের ফিলিস্তিনি ভাইদের সমর্থনে এগিয়ে আসতে হবে। শাসকরা ভয়-ভীতি নিয়ে দূর থেকে তা দেখবে।