বিশেষ প্রতিবেদক: বিপুল সংখ্যাধিক্যে রাষ্ট্রসংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলি শুক্রবার রাতে গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের নৃশংস হামলা বন্ধ এবং এক মানবিক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করেছে। অবরুদ্ধ ও ইসরাইলি আক্রমণে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত গাজায় দু’পক্ষের যুদ্ধবিরতি এবং জরুরি ত্রাণ সাহায্য প্রেরণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে।
দুনিয়ার অধিকাংশ রাষ্ট্র যে এই গাজায় ইসরাইলের বর্বরতাকে পছন্দ করছে না, তা জেনারেল অ্যাসেম্বলির ভোটাভুটিতে স্পষ্ট হয়ে গেছে। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে পৃথিবীর ১২০টি দেশ। আর বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ১৪টি রাষ্ট্র। ৪৫টি দেশ ভোটদানের সময় অনুপস্থিত ছিল। আমাদের দেশ ভারতও ভোটদানে গরহাজিরদের মধ্যে সামিল রয়েছে। কানাডাও ভোট প্রদানে অংশগ্রহণ করেনি। কারণ, হামাস ইসরাইলে ৭ অক্টোবর যে হামলা চালিয়েছিল, কানাডা তাকে ‘সন্ত্রাসী হামলা’ আখ্যা দিয়ে প্রস্তাবের অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। সেইসঙ্গে হামাস যেসমস্ত যুদ্ধবন্দিকে ধরে নিয়ে গেছে, তাদের তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দেওয়ার কথাও কানাডা প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিল। তবে ইসরাইলের সপক্ষে কানাডার এই প্রস্তাবগুলি চিন, রাশিয়া ও অন্য দেশগুলি মেনে নেয়নি। ফলে কানাডার এই শর্তগুলি প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
বিপুল ভোটে ১২০টি রাষ্ট্রের সমর্থনে এই প্রস্তাব রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, দুনিয়ার বেশির ভাগ দেশই ইসরাইলি বর্বরতার বিপক্ষে।
কিন্তু হলে কি হবে! ইসরাইলের পক্ষে রয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ। তারাই ইসরাইলকে নতুন মারণাস্ত্র ও অর্থবল জোগাচ্ছে। ফলে এতগুলি রাষ্ট্রের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে ইসরাইল বলেছে, আমরা রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির ‘ঘৃণ্য আহ্বানকে’ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছি। ইসরাইল হামাসকে নির্মূল করতে চায়। যেভাবে নাৎসিদের এবং আইএস-কে নির্মূল করা হয়েছে, ইসরাইলও সেভাবেই হামাসকে নির্মূল করতে চায়।
কিন্তু সারা বিশ্বের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসরাইল ফিলিস্তিনে যে গণহত্যা, নির্যাতন এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, তা হিটলারের কথিত হলোকাষ্টকে বহু গুণে হার মানিয়েছে। তারা হাসপাতালেও হামলা চালিয়ে যেভাবে রোগী ও সেখানে আশ্রয় নেওয়া সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে, তা বিশ্বের ইতিহাসে একটি কুনজির হিসেবে বিবেচ্য হবে। আর ইসরাইল শিশু ও নারীদের যেভাবে হত্যা করছে, তা ইতিহাসের আর কোনও নিধনযজ্ঞে দেখা যায়নি।
রাষ্ট্রসংঘে প্রস্তাবটি পাস হওয়ার পর এক বক্তৃতায় ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত গিলাদ এরদান বলেন, আজ এমন একটি দিন যা ‘কুখ্যাত’ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমরা সবাই দেখছি, রাষ্ট্রসংঘের আর বৈধতা বা প্রাসঙ্গিকতা নেই। তিনি আরও বলেন, এই প্রস্তাব পাসের মধ্য দিয়ে অধিকাংশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেখিয়ে দিয়েছে, তারা ইসরাইলের পক্ষে নয় এবং স্বাধীনতাকামী হামাসকেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্ত্রাসী সংগঠন বলে মনে করে না।
এদিকে আমাদের দেশ ভারত বরাবর মানবতার পক্ষে অবস্থান নিলেও রাষ্ট্রসংঘের ভোটাভুটিতে তারা ভোটদানে বিরত ছিল। এর অর্থ দাঁড়ায়, মানবিক সাহায্যের জন্য যুদ্ধবিরতিতে যারা সায় দিয়েছে, মোদি সরকারের প্রতিনিধি জেনারেল অ্যাসেম্বলিতে সেই প্রস্তাবকে সমর্থন করেননি। ভারত সব সময় মানবিককার পক্ষে থেকেছে। আর বর্তমানে মোদি সরকার ইসরাইলের বিশেষ বন্ধু হিসেবে এমন একটি অবস্থান নিল যাতে ভারতবাসীর লজ্জায় মুখ ঢাকতে হচ্ছে। আর বর্তমানে ভারতে এমন কিছু সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদের প্রসার ঘটছে, যারা গাজায় হত্যাযজ্ঞের সপক্ষে পুজাপাঠ করছে। আর ইসরাইলের বিজয় কামনা করছে। অন্যদিকে গাজার বাসিন্দা ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাও তাদের প্রতিজ্ঞায় অনঢ়, তারা ফিলিস্তিন ছেড়ে যাবে না। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত তারা লড়াই করে যাবে। তাই শাহদতবরণ নিশ্চিত জেনেও হামাসের একজনও যোদ্ধা গাজা ত্যাগ করেনি। তারা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে বদ্ধপরিকর। আর সমগ্র সভ্য দুনিয়া দেখছে, কীভাবে আমেরিকা ও ইসরাইল নরসংহার চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের বিরোধী নেতৃবৃন্দ মোদি সরকারের এই অবস্থানের নিন্দা করেছেন। তাঁরা বলছেন, ভারতের উচিত ছিল মানবিকতার সপক্ষে দাঁড়ানো। কিন্তু মোদি সরকার জায়নবাদী ইসরাইলের অত্যাচার, বর্বরতা ও নরমেধযজ্ঞকেই বকলমে সমর্থন জানাল।