আহমদ হাসান ইমরান: এটা ঠিক পুবের কলম পত্রিকায় প্রথমেই বলা হয়েছিল, অনন্যেপায় হয়ে ‘দুনিয়ার সব থেকে বড় কারাগার’ অবরুদ্ধ গাজার কর্তৃপক্ষ হামাস ইসরাইলে আক্রমণ চালিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, ইসরাইলের সামরিক শক্তির কাছে হামাস একটি ছোট্ট গ্রুপ মাত্র। আর সেইসঙ্গে ইসরাইল একা নয়, তার পিছনের রয়েছে দুনিয়ার সব থেকে বড় পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
তারাই অর্থ ও উন্নতমানের সামরিক হাতিয়ারের জোগান দিয়ে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে পশ্চিম এশিয়ায় টিকিয়ে রেখেছে। তার সঙ্গে রয়েছে ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি পশ্চিমা দেশ। ভারতের মোদি সরকারও এখন আরবদের ছেড়ে ইসরাইলের দিকেই হেলে পড়েছে। তারাও ইসরাইলকে সবদিক থেকে সমর্থন দিচ্ছে।
আর সেই তুলনায় হামাস কি? বিশ্লেষকরা বলবেন, কিছুই না। একটা সশস্ত্র গোষ্ঠী যারা স্বাধীকার ও স্বভূমি উদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করে চলেছে। সংগ্রাম করে চলেছে মানুষের জিন্দেগী পাওয়ার জন্য।
পশ্চিমা মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ। কে জিতবে? মনে হচ্ছে, হামাস যেন ছোট্ট একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী নয়, তারা ইসরাইল ও আমেরিকার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো একটি বিশাল সামরিকশক্তি। এইসবই হচ্ছে মানুষের ইনসাফের কণ্ঠকে চেপে দেওয়ার পশ্চিমা ও জিওনিস্ট প্রচারণা। হামাস অস্ত্র পাবে কোথায়?
লুকিয়ে, চুরিয়ে অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলের স্যাটেলাইট-সহ আর সব ধরনের নজরদারির মধ্যে তারা কোনওক্রমে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আর তাদেরকেই বলা হচ্ছে, তারা আইএসআইএস-এর থেকেও ভয়ংকর।
হামাস ও ফিলিস্তিনবাসীকে দু-দু’টি প্রায়শ্চিত্ব করতে হচ্ছে।
একটি হল, খ্রিস্টানরা যিশুর হত্যাকারী হিসেবে ইহুদিদের জেরুসালেম ও ওই এলাকা থেকে বিতাড়িত করে। তখন মুহাম্মদ সা.-এর অনুসারি মুসলিমদের দুনিয়ায় উপস্থিতই ছিল না। এরপর খ্রিস্টানরাই ইহুদিদের পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয়। ইহুদিরা ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। সেখানেও খ্রিস্টানরা তাদেরকে মানুষের স্বীকৃতি দেয়নি।
পোল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি এবং অন্য সব খ্রিস্টান দেশে তাদের শহরে থাকতে দেওয়া হত না। শহরের বাইরের ঘেটোতে তাদের নারকীয় জীবনযাপন করতে হত। কিন্তু মুসলিম শাসকরা জেরুসালেমে সামান্য কিছু ইহুদিকে সুরক্ষা দিয়ে রেখেছিল। অটোমান খিলাফতেও ইস্তাম্বুল প্রভৃতি শহরে ইহুদিদের ব্যবসা ও বড় বড় সরকারি পোস্ট দেওয়া হত।
তারপর জার্মানিতে ইহুদিদের সঙ্গে হিটালের বিবাদের কথা সকলেই জানেন। ইহুদিরা বক্তব্য, হিটলার তাদের ধরে গ্যাস চেম্বারে হত্যা করেছে। হলোকাষ্টে হাজার হাজার ইহুদি মারা গেছে। এরপর জিওনিস্ট লবির চাপে হঠাৎ করে পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান দুনিয়া ইহুদিদের সমর্থক হয়ে ওঠে এবং তাদের জন্য একটি ইহুদি-ভূমির সন্ধান করতে থাকে।
এ জন্য আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় জায়গাও দেখা হয়েছিল। কিন্তু জিওনিস্টরা চায় যে, ফিলিস্তিনই যেন তাদেরকে দেওয়া হয়। আর তাই জিওনিস্ট সন্ত্রাসবাদীরা এবং দখলদার ব্রিটেনের সহায়তায় ফিলিস্তিন ভূমি থেকে শত শত বছর ধরে বসবাস করা ১০ লক্ষ মুসলিমদের সেখান থেকে স্রেফ তাড়িয়ে দেওয়া হয়। খ্রিষ্ট ধর্মালম্বী হিটলার ইহুদিদের হত্যা করে যে অপরাধ করেছিল, তার প্রায়শ্চিত্য করতে হল ফিলিস্তিনি মুসলিমদের। কিন্তু এই প্রায়শ্চিত্য করা উচিত ছিল খ্রিস্টানদের। আসলে ক্ষমতা থাকলে সবই করা যায়।
দ্বিতীয় যে প্রায়শ্চিত্য করতে হচ্ছে ফিলিস্তিনবাসীকে তাহল, তাদের কিছু আরব সরদার অটোমান বা উসমানীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের প্রচারণায় বিদ্রোহ করে বসে। তারা ইংরেজদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তুরস্কে অবস্থিত উসমানীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ চক্রান্তে সামিল হয়। তারা ইসলামকে বাদ দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদে মেতে ওঠে। ফলে ইংরেজরা জেরুসালেম-সহ ফিলিস্তিনকে তুর্কীদের হাত থেকে নিয়ে নেয়।
এই বিদ্রোহে আরবদের মধ্যে ছিলেন মক্কার শাসক শরীফ হোসেনও। তাঁর বংশধররা এখন জর্ডনের শাসক। আর বেদুইন সরদার ইবনে সউদও যোগ দেয় ব্রিটিশদের সঙ্গে এবং তাদের সহায়তায় সে হিজাজের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে বসে। আর ব্রিটিশরা তাকে মক্কা ও মদীনার শাসক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ইবনে সউদের নামে গঠন করা হয় সউদি আরব রাষ্ট্র। এই আরবরা যে ভুল করেছিল, তারও প্রায়শ্চিত্য করতে হচ্ছে জেরুসালেম-সহ সমগ্র ফিলিস্তিনকে।
এখন গাজার শরণার্থী শিবির থেকেও ফিলিস্তিন মুসলিমদের বের করে দেওয়া হচ্ছে। এটা যে কত বড় অন্যায় ইতিহাস তা অবশ্যই একদিন বলবে। আর ফিলিস্তিনদের উপর যে আধুনিক অস্ত্রের দ্বারা যে হত্যাযজ্ঞ চলছে, নারী-পুরুষ-শিশুকে বোমা ও ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, আর সভ্য দুনিয়া হাততালি দিচ্ছে, এটাও ফিলিস্তিনীরা তো বটেই, সমগ্র মুসলিম জনসাধারণ মনে রাখবে।
আর মনে রাখতে হবে যে, পদলেহী মুসলিম রাজা, বাদশাহ, স্বৈরাচারী শাসকরাই সব নয়। রয়েছে বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলিম। তারা এই স্মৃতিকে ভুলে যাবে না পশ্চিমা প্রচারণা সত্ত্বেও। আর এর মূল্য একদিন জায়নবাদী ইসরাইল এবং পশ্চিমাদের অবশ্যই চুকাতে হবে।