বিশেষ প্রতিবেদন: বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জলে ডুবে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা সুন্দরবনে, একটি রিপোর্টে এমন একটি তথ্য সামনে এসেছে। সুন্দরবন পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি ম্যানগ্রোভ অঞ্চল বেষ্টিত প্রশস্ত বনভূমি।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে শিশুদের ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রতি এক লক্ষ জনংখ্যার মধ্যে ২৪৩টি এক থেকে চার বছর বয়সি শিশুর মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবে। অন্য দিনে ৩৯ জন পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সি শিশুর মৃত্যু হয়েছে একইভাবে। এই জলে ডোবা রুখতে বেশ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে সুন্দরবন এলাকায়। সংগঠনের সদস্যরা জানাচ্ছেন, বাড়ির লাগোয়া পুকুরে ডুবেই সবচেয়ে বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। অনেক সময় জীবিত অবস্থায় শিশুদের উদ্ধার করা গেলেও তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় না। পরিবারের লোকেরা ওঝা-গুনিনের কাছে নিয়ে যায়। এই কারণেও মৃত্যু হয় অনেক শিশুর। করোনা মহামারির আগে থেকে বিগত তিন বছরে এক থেকে চার বছরের শিশুদের মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। পরিবারের লোকজন যখন বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকেন, সেই সময় খেলতে খেলতে শিশুরা পুকুরে কাছে চলে যায়। কোনও ভাবে পুকুরে পরে গেলে বাঁচানোর কেউ থাকে না। ফলে পুকুরে ডুবে মৃত্যু হয় তাদের।
২০১৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি লাখ জনসংখ্যার মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার ৩৮.৮, এদের বয়স পাঁচ থেকে নয় বছরের মধ্যে। ১৯টি ব্লকের মধ্যে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১৩টি ও উত্তর ২৪ পরগনার ৬টি অঞ্চলে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। ছেলে ও মেয়েদের মৃত্যুহারে কোনও পার্থক্য নেই।
বেসরকারি সংস্থা চাইল্ড ইন নিড ইনস্টিটিউট (সিআইএনআই), বিশ্বব্যাপী সংস্থা রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন (আরএনএলআই) এবং দ্য জর্জ ইনস্টিটিউট (টিজিআই) এর সঙ্গে অংশীদারিত্বে শিশুদের মধ্যে জলে ডুবে যাওয়া নিয়ে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল।
সুন্দরবনে ১০০টি দ্বীপে বিস্তৃত এবং প্রায় ৪০ লক্ষ বাসিন্দার বসবাস। মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫.৯ শতাংশ হল এক থেকে ৯ বছরের মধ্যে বয়সী শিশু।
বর্ষাকালে সুন্দরবনের জলাশয়ে জলস্তর বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলে গত চার-পাঁচ বছরে বন্যার ঘটনাও বেড়েছে। প্রত্যন্ত এলাকায় থাকার জন্য অনেক সময় চটজলদি স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকেও তারা বঞ্চিত হচ্ছে। রয়েছে সচেতনতার অভাব। সমাধানের রাস্তা হিসাবে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি মনে করছে, ছোট থেকে বাচ্চাদের সাঁতার শেখাতে হবে। তারা যাতে পুকুরের কাছে না যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। প্রয়োজনে পুকুরের চারপাশ ভালো করে বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখতে হবে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে কাজে লাগিয়ে গ্রামে গ্রামে ‘চাইল্ড কেয়ার সেন্টার’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা হয়েছে। বাবা-মা কাজে ব্যস্ত থাকলে এই সেন্টারগুলি বাচ্চাগুলির দেখাশোনা করবে।
রাজ্যের সুন্দরবন বিষয়ক মন্ত্রী বঙ্কিম চন্দ্র হাজরা শিশুদের ডুবে যাওয়ার সমস্যার কথা স্বীকার করে বলেছেন যে, রাজ্য সরকার এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। তবে শিশুদের জলে ডুবে মৃত্যু নিয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। মন্ত্রীর মতে, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, বাল্যবিবাহ সম্পর্কে জানানোর মতো সুন্দরবনের বাসিন্দাদের মধ্যে ডুবে যাওয়ার বিষয়ে নিয়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে। মন্ত্রী বঙ্কিম চন্দ্র হাজরা আক্ষেপ করে বলেন, জলে ডুবে প্রতি বছরই শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে।
সিআইএনআই-এর অফিসার সুজয় রায় বলেছেন যে সমীক্ষা শুধুমাত্র স্থানীয়দের জন্য নয়, নীতিনির্ধারকদের সামনে পরিস্থিতি তুলে ধরতেও সাহায্য করবে৷ সুজয় রায় আরও বলেন, শিশুদের জলে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা খুবই হৃদয়বিদারক। সরকারের এই পরিস্থিতি আরও দায়িত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত। তবে সম্প্রতি করা এই সমীক্ষাটি স্থানীয় সহ সরকারকে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, সেপ্টেম্বরে কেরলের তিরুবনন্তপুরমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) দ্বারা যৌথভাবে ডুবে যাওয়া প্রতিরোধের প্রথম জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।