দেবিকা মজুমদার
সাপ শব্দটা শুনলেই প্রথমেই যে অনুভূতিটার উদ্রেক হয়– সেটা হল ভয়। যদিও আমাদের থেকে অনেক বেশি আতঙ্কিত হয় আমাদের সামনে হঠাৎ করে চলে আসা সরীসৃপ প্রাণীটি। তাই ভয়ে আমাদের দিকে ফণা তুলে আসতে দেখা যায় বিষধর সাপেদের। আর তার পালটা আমরাও কখনও কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে আবার কখনও একেবারে লাঠি হাতে সাপটিকে আঘাত করে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করি। এই ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা থেকে সাপকে বাঁচাতে ছোটবেলা থেকে কাজ করছেন ডানকুনির কৃষ্ণপুর দাসপাড়ার বাসিন্দা সমীরণ বারিক। ২৬ বছর বয়সি এই যুবক এখনও পর্যন্ত শতাধিক বিষধর সাপকে উদ্ধার করেছেন। শুধু তাই নয়– স্থানীয় বিডিও অফিসই হোক আর পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ি– সাপ ঢুকলেই বন দফতরের তরফ থেকে ডাকা হয় সমীরণ বারিককে।
না– সমীরণ কোনও সাপুড়ে নন। সাপ নিয়ে কোনও খেলা দেখান না তিনি। শুধুমাত্র সাপ উদ্ধার করে নিয়ে যান এবং একটি নির্দিষ্ট পরিসরের মধ্যে জঙ্গলে আবার সাপটিকে ছেড়ে দেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সাপের প্রকৃতি– তাদের গায়ের রং– বিশেষত্ব– বিষের সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে ইউটিউবে মঝেমাঝে ভিডিয়ো আপলোড করেন তিনি। আবার ওই ভিডিয়োতে কখনও কখনও সাপুড়েদের বিভিন্ন মিথ্যে কারসাজিও ফাঁস করেন তিনি। আর এতেই সমস্যা। সমীরণ বারিক ‘পুবের কলম’কে জানিয়েছেন– তিনি গত দেড় বছর ধরে এই ধরনের ভিডিয়ো ইউটিউবে আপলোড করছেন। তবে– সম্প্রতি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের তরফ থেকে তাঁর কাছে বেশ কিছু হুমকি-ভরা ফোন আসছে। বনদফতরের কর্তাদের নাম করে তাঁকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হচ্ছে যে– তিনি নাকি ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ’ আইন লঙ্ঘন করছেন। তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। সমীরণ বলেন– ‘আমি ছ’বছর বয়সে প্রথম সাপ উদ্ধার করা শুরু করি। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত দেড়শোরও বেশি সাপ উদ্ধার করেছি। তবে– এই ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল আরও অনেক ছোট বয়সে। প্রথমবার যখন সাপ ধরি– তখন আমার বয়স ৬ বছর। একটা সাপ জালে আটকে গিয়েছিল। লাঠি দিয়ে মাথা চেপে ধরে জাল কেটে পাশের খুপড়িতে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি। বাড়ির লোকেরা বলত– ছোটবেলা থেকেই নাকি আমার পাশে একটা গোখরো সাপ ঘোরাফেরা করত। তবে আমি বিজ্ঞানমনস্ক– তাই এসব মানি না। আমি পশু-পাখি ভালোবাসি। প্রকৃতিকে ভালোবাসি। প্রকৃতির জন্য আমি প্রাণও দিতে পারি। আমার কখনও কোনও বন্যপ্রাণী বা পশুকে ভয় লাগেনি’।
সমীরণ জানান, এতদিন পর্যন্ত তিনি এভাবেই শাখামুটি– কালাচ– গোখরো– সিন্ধু কালাচের মতো একাধিক বিষধর সাপ উদ্ধার করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে ডাকলে তিনি হাজির হয়ে যান সাপ উদ্ধার করতে। তার বিনিময়ে কোনও টাকা-পয়সার দাবি করেন না পেশায় মিস্ত্রি সমীরণ বারিক। টাকা রোজগারের জন্য তিনি সাপ উদ্ধার করেন না। সমীরণ বারিক মানুষের বাড়িতে টিনের শেড লাগানোর কাজ করেন। পাশাপাশি লোকের বাড়িতে জল দিয়ে– ভ্যান চালিয়েও রোজগার হয় তাঁর। এহেন সমীরণের বিরুদ্ধে ‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন’– ১৯৭২ লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলা প্রসঙ্গে ‘পুবের কলম’-এর তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিশিষ্ট আইনজীবী অভিজিৎ বরণ দাস এবং সুবীর ব্যানার্জির সঙ্গে। দুই আইনজীবীরই অভিমত– সাপকে বিপদসংকুল জায়গা থেকে উদ্ধার করে তাকে পুনরায় তার বাসযোগ্য নিরাপদ স্থানে ছেড়ে দেওয়া বা সাপের প্রকৃতি চিনিয়ে দিয়ে ইউটিউবে ভিডিয়ো আপলোড করা কোনওভাবেই আইনের লঙ্ঘন নয়। এমনকী– সেক্ষেত্রে ইউটিউব থেকে কোনওরকম আয় হলে তার সঙ্গে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কোনও সম্পর্ক নেই।