আহমদ আবদুল্লাহ: নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাধর দেশগুলির মন্তব্যে বাংলাদেশের ভোট পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল হয়ে উঠেছে। প্রায় এক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক বিবৃতি দিচ্ছিল যে, তারা বাংলাদেশে স্বাধীন ও অবাধ নির্বাচন চায়। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করেনি, একইসঙ্গে বাংলাদেশীদের ভিসা ও অন্যান্য বিষয়েও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশকে নিজের রফতানির জন্য অনেকটা নির্ভর করতে হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথা মেনে অবাধ নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের যে শাসন ক্ষমতা হারানোর সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তা বলছেন ঘরে-বাইরে সব পর্যবেক্ষকরাই। কাজেই হাসিনা সরকার তা কি করে মেনে নেবে!
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলি বাংলাদেশে নির্বাচন সম্পর্কে যে নীতি-অবস্থান গ্রহণ করেছে, তাতে খালেদা জিয়ার বিএনপি যথেষ্ট উজ্জীবিত। তাদের মনে হয়েছে, কেল্লা প্রায় ফতেহ হয়ে গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের জনগণের কাছেও একটি পয়গাম গেছে যে, সরকার পরিবর্তন হওয়া এবার দূরুহ নয়।
ভারত এতদিন সরাসরি কোনও বার্তা দেয়নি। নয়াদিল্লি চুপচাপ অবস্থা দেখে যাচ্ছিল। দিনকয়েক আগে আওয়ামী লীগের এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল এসে বিজেপি-র শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করে। তারও প্রায় এক বছর আগে বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী শ্রী আবদুল মোমেন নয়াদিল্লি এসে কাতর আর্জি জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় থাকে তা ভারতকে দেখতে হবে। এনিয়ে বাংলাদেশে বেশ হইচই হয়। আওয়ামী লীগ সরকার না থাকলে ভারতের স্বার্থের কি ধরনের ক্ষতি হবে, তাও আবদুল মোমেন পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।
নয়াদিল্লিতে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দদের বৈঠকের পর ভারত সিদ্ধান্ত নেয়, আর অপ্রত্যক্ষভাবে নয়, এবার সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সমর্থনে নামতে হবে। আর তাও রাগঢাক রেখে নয়, একেবারে স্পষ্টভাবে। ভারত ওয়াশিংটনকে বাংলাদেশ নিয়ে এক কড়া বার্তা প্রদান করে। শুধু তাই নয়, এই বার্তাটি যাতে মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় তারও ব্যবস্থা করে। বোঝা যায়, নরেন্দ্র মোদি সরকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সবকিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
স্বাভাবিকভাবেই হতাশ বিরোধী দল বিএনপি-র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, ভারত সবসময় গণতন্ত্রের কথা বলে। কাজেই ভারতের এই বার্তা অপ্রত্যাশিত। তিনি আরও বলেছেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের রাজনীতির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত এই মন্তব্য করেছে। অর্থাৎ বকলমে বিএনপি-র মহাসচিব বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি ওবায়েদুল কাদের বলেন, যারা ভারতের হস্তক্ষেপের কথা বলেন, তাঁদের বলব, ৭১ সালে কি হয়েছিল। ভারত এগিয়ে এসেছিল, তাদের সৈন্যরা বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য রক্ত দিয়েছে। আমাদের লোকজনকে বিশেষ করে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে, ট্রেনিং দিয়েছে, সেটা কি অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ ছিল না?
কেন ভারত পুনরায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় চায়, তাদের ‘লীক’ করা কূটনৈতিক বার্তায় তা বলে দেওয়া হয়েছে। সাউথ ব্লক বলেছে, জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক ছাড় দেওয়া হলে শীঘ্রই ঢাকা মৌলবাদীদের দখলে চলে যাবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের হঠাৎই দখলদারি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর গোটা অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে। মিত্র শেখ হাসিনা না থাকলে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অশান্তি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। নয়াদিল্লির আরও বক্তব্য, জামায়াতকে ছাড় দিলে ভারতে আন্তসীমান্ত সন্ত্রাস বাড়তে পারে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামী একটি ‘উগ্র মৌলবাদী সংগঠন’ বলেই নয়াদিল্লি মনে করে।
নয়াদিল্লিতে আসা বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গেও বৈঠক করেন। রাজ্জাক পরে সাংবাদিকদের বলেন, শেখ হাসিনাই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারবেন। আর তিনি বাংলাদেশের মাটিকে কখনই ভারত বিরোধী তৎপরতায় ব্যবহার করতে দেবেন না।
তবে শেখ হাসিনার পক্ষে ভারতের অবস্থান নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের দু’টি বিতর্কিত নির্বাচনের সময়েও শেখ হাসিনা সরকারকে নয়াদিল্লি সমর্থন দিয়েছে। এবারও যে তার ব্যতিক্রম হবে না তা সম্পূর্ণ পরিস্কারভাবে দেশে-বিদেশে সকলের সামনে এসেছে। আর বিএনপি এখনও হাসিনার বিকল্প হিসেবে ভারতের আস্থা অর্জন থেকে যোজন দূরে রয়েছে। আর পর্যবেক্ষকরা এও বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটু হম্বিতম্বি করলেও বিশ্ব রাজনীতির চাপে তারা কখনই ভারতকে চটাতে পারবে না। নরেন্দ্র মোদি সরকার মার্কিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘বাংলাদেশ নীতি’র বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। কাজেই শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায় ফেরার বিষয়ে কার্যত নিশ্চিত।
তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভারত জামায়াতের কথা বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও তাদের নীতি পরিবর্তন করতে বলেছে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও ইসলাম-ভীতি রয়েছে। কিন্তু একটা কথা অনেকেই বুঝতে পারছেন না, আর তা হল ভারতে যারা ক্ষমতায় রয়েছে সেই বিজেপি এবং তাদের সহযোগী সংস্থা বিশ্বহিন্দু পরিষদ, বজরং দল যেভাবে সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টানদের প্রতি অব্যাহতভাবে আক্রমণ শানাচ্ছে, লিঞ্চিং দ্বারা হত্যা করছে, সেক্যুলার সংবিধান পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, সরকার বুলডোজার চালাচ্ছে, পুলিশ-প্রশাসন হামলাকারীদেরই সাহায্য করছে, ঘৃনা-বিদ্বেষ প্রচার করছে তা যেকোনও মুসলিম বা খ্রিস্টান মৌলবাদী দল থেকে অনেক অনেক বেশি ভয়ংকর। কিন্তু মোদি সরকার মনে করে বিশ্বহিন্দু পরিষদ, বজরং দল এগুলি খুবই কোমলপন্থী দল। এদের সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতের নাকি তুলনা চলে না। তাই যেকোনও মূল্যে বাংলাদেশে জামায়াতকে রুখতে হবে। ফলে অ্যাডভান্টেজ শেখ হাসিনা।