এ হাসান: মণিপুর। ইন্ডিয়ার এই ছোট রাজ্যটির কথা আগে কখনোই এত ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। এখন মণিপুর জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বের খবরের মানচিত্রে। আর এতে ভারতের যে চিত্র দুনিয়াবাসীর সামনে এসেছে, তা অবশ্যই মাথা হেঁট করে দেওয়ার মতো।
যে সে নয়, বলেছেন খোদ এই বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী। ১৪০ কোটি মানুষের শাসনভার যার উপর, সেই নরেন্দ্র মোদিজি। কথা হচ্ছে, সকলেই জানেন মোদিজি বসে থাকেন না। সুযোগ পেলেই তিনি সফর করেন। যান বিদেশে, একের পর এক দেশে। মণিপুরে যখন হত্যাযজ্ঞ, প্রাণহানি, মহিলাদের ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ চলছে সেই সময় মোদিজি একের পর এক দেশে ভ্রমণ করে পরদেশে তিনি কতটা জনপ্রিয় তা প্রমাণ করেছেন। বিজেপি ছাড়া ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সোসাইটি চাইলেও তিনি কিন্তু মণিপুরে যাওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেননি। প্রায় ৭৯ দিন পর তিনি ঘোষণা করেছেন, তাঁর লজ্জাবোধ হচ্ছে। ঠিক কথা, লজ্জা জিনিসটি সহজে যায় না। তাই মোদিজির লজ্জা হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, কেন মণিপুরে হিন্দু মেইতেই এবং খ্রিস্টান কুকিদের মধ্যে এই চরম ঘৃণা-বিদ্বেষ, শত-শত বছর ধরে তারা একসঙ্গে রয়েছেন। এই ছোট রাজ্যটিতে চেষ্টা করলে সহিংসতা দমানো এবং রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া মোটেই কঠিন ছিল না। মণিপুরে তো যথেষ্ট ভারতীয় সেনাবাহিনী পাঠানো হয়েছে। এই অমিত শাহ তো ৩৭০ ধারা তোলার পর নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে কাবু করে দিলেন কাশ্মীরিদের। ধরে ফেললেন পুলওয়ামার ষড়যন্ত্রকারীদের।
মণিপুরে কী হল? প্রায় ৮০ দিন ধরে একটি রাজ্যে নেই আইন-শৃঙ্খলা, নেই মহিলাদের নিরাপত্তা, বেটিদের পড়া তো দূরের কথা, বাঁচারও অধিকার নেই। ঘরহারা মানুষদের জন্য নেই পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা। সাংবিধানিক সমস্ত রক্ষাকবচ বিনষ্ট হয়ে গেছে। এসব দেখেও মোদি ও অমিত শাহ চুপ।
মণিপুরে যে ধর্ষণ-কাণ্ড হচ্ছে, মহিলাদের চরম অপমান করা চলছে, তাদের চোখের সামনে পিতা ও ভাইকে হত্যা করে রেপ করা হচ্ছে, এই সবই কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং, জাতীয় মহিলা কমিশন এবং অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহের জানা ছিল। নইলে কেন এত সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা, এজেন্সি, আইবি, এনআইএ-সহ আরও কত সংস্থা রয়েছে মোদি ও শাহজির হাতে। তারা কোনও না কোনও রিপোর্ট দিচ্ছে! ইন্টারনেট চালু হওয়ার পর না হয় ট্যুইটারে সেই ধর্ষণ ও নগ্ন প্যারেডের ছবি অল্প সময়ের জন্য সামনে এসেছিল। শাহজিরা তা ডিলিট করে দিতে ট্যুইটার, ইউটিউবকে বাধ্য করেছেন। আর করবেন নাই বা কেন, তাঁদের যে লজ্জা লাগছিল! অথচ জেনে, বুঝে সমস্ত খবর রেখে তাঁরা চুপ করেছিলেন।
মণিপুরে সরকার ও প্রশাসন কিন্তু নিরপেক্ষ নয়। মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং ভয়ংকরভাবে ভূমিপুত্র কুকিদের বিরোধী। তাঁর বক্তব্য, কুকিরা সব নাকি মায়ানমারের বাসিন্দা। এ ছাড়াও কুকিদের বিরুদ্ধে তাঁর রয়েছে আরও অনেক ঘৃণা ছড়ানো মন্তব্য।
কথা হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠলেন। বলতে পারেন, প্রায় ৮০ দিন পর তিনি অপরাধী মাত্র চারজনের ফাঁসির কথা বলছেন। এই ঘৃণ্য ঘটনার এফআইআর হয়েছিল প্রায় দু’মাসেরও বেশি আগে। জাতীয় মহিলা কমিশনেও অভিযোগ জমা পড়েছিল ১২ জুন, ২০২৩। ক্ষমতাসীনরা যে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন, তা এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
তবে মোদিজি মুখ না খুললেই বোধহয় ভালো ছিল! তাঁর মর্যাদার পক্ষে হয়তো একটি আড়াল কিংবা পর্দা থাকত। তিনি কী বললেন? মণিপুরের এই বীভৎস ঘটনার কথা বলতে গিয়ে তাঁর মনে পড়ে গেল, রাজস্থান ও ঝাড়খণ্ডের কথা। মণিপুর সম্পর্কে তাঁর স্মৃতি বিলোপ হলেও তিনি কিন্তু রাজস্থান ও ঝাড়খণ্ডের কথা ভোলেননি! তিনি সারাদেশের সর্বেসর্বা প্রধানমন্ত্রী। সবাইকে তো তাঁকে দেখতে হবে, তাই ঝাড়খণ্ড-রাজস্থান। কী জানি এতে যদি মণিপুর খানিকটা চাপা পড়ে যায়!
কত মহিলা উপর মণিপুরে অত্যাচার হয়েছে, তা ফাঁস করে দিয়েছেন খোদ মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ১৮ মে এই ঘটনার যে এফআইআর হয় তা কি তিনি জানতেন? জনাব উজিরে আলা বলেন, এই ধরনের ১০০-রও বেশি এফআইআর রয়েছে। এই ধরনের শত শত ঘটনা ঘটেছে। আর এজন্যই তো আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছিলাম। আমরা নগ্ন প্যারেডের ঘটনায় তো চারজনকে গ্রেফতার করেছি।
প্রশ্ন উঠেছে, এতদিন কেন গ্রেফতার করা হল না? এতদিন কেন মোদি ও অমিত শাহ ‘লজ্জা’ পেলেন না, কে জানে, কী আছে বিধাতাদের মনে!
অনেকে বলছেন, মণিপুর পুরোপুরি গুজরাত সহিংসতার পুনরাবৃত্তি। সেখানে যেমন সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে পুলিশ প্রশাসন এবং সংখ্যাগুরু শাসক চরমপন্থীরা একজোট হয়েছিলেন, গণহত্যায় অংশ নিয়েছিলেন। মণিপুরেও সেই একই দৃশ্য। যে তরুণীটিকে নগ্ন করে ধর্ষণ করা হয়েছে, তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, উন্মত্ত জনতার সঙ্গে পুলিশও শামিল ছিল। আর তারাই আমাদের ওই উগ্র জনতার হাতে ছেড়ে দেয়। অর্থাৎ পুলিশ চেষ্টা করলে ওই তরুণীদের রক্ষা করতে পারত। কিন্তু রক্ষকই যেখানে ভক্ষক, সেখানে আর কী বলা যেতে পারে! গুজরাতে যেমন সংখ্যালঘু মুসলিমদের হত্যা ও ধর্ষণ করা হয়, মণিপুরেও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে তাই করা হচ্ছে। সারা দুনিয়া কিন্তু গুজরাত ও মণিপুরের সাক্ষী থাকছে।
গুজরাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে মাত্র কয়েকটি ঘটনার তদন্ত হয়েছিল। বিলকিস বানুর ঘটনায় তাঁর আত্মীয়দের হত্যা, তাঁর ছোট মেয়েকে বিলকিসের সামনে পাথরে আছড়ে খুন করা এবং তাঁকে গণধর্ষণ করার মামলায় ফাঁসি নয়, ১০-১২ জনের যাবজ্জীবন হয়েছিল। তাদের সরকার মুক্ত করে দিয়েছে। কারণ, ওই খুনি-ধর্ষকরা নাকি ‘সংস্কারী ব্রাহ্মণ’। মণিপুরেও হত্যা ও ধর্ষণকারীদের হয়তো কিছুদিন পর সসম্মানে মুক্তি দিয়ে আধিপত্যবাদের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হবে।