পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: উত্তরাখণ্ডের উত্তরকাশী জেলার পুরালা শহরে স্থানীয়রা জানায়, তারা একটি নাবালিকা মেয়ের অপহরণ ব্যর্থ করে দেয়। অভিযুক্ত দুই যুবক একজন হিন্দু এবং একজন মুসলিম। নাবালিকার চাচা ৪০ বছর বয়সি স্কুল শিক্ষক। তিনি একটি এফআইআর দায়ের করেন, পরের দিন তাদের গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনার পর শহরের পরিস্থিতি পালটে যায় কারণ ঘটনাটিকে ‘লাভ জিহাদের’ রং দেওয়া হয়েছিল, ফলে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা তৈরি হয়। ঘটনার সূত্রপাত ২৬ মে। অভিযোগ, সেই দিন এলাকার এক হিন্দু পরিবারের মেয়েকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এই ঘটনায় অভিযোগ করা হয় কেবলমাত্র এক মুসলিম পরিবারের সদস্যের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনা ঘিরে দুই পক্ষের সংঘাতে মুসলিমদের দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয় এলাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কিশোরীর চাচা স্কুল শিক্ষক সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার পর তার জীবন জীবন্ত জাহান্নামে পরিণত হয়েছে। এটি কখনই লাভ জিহাদ মামলা ছিল না, তবে একটি অপরাধ। ডানপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো এটাকে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে পরিণত করার জন্য জোর দিয়েছিল। এমনকী তারা নিজেরাই আমাদের হয়ে পুলিশে অভিযোগ করেছে। পুলিশ আমার পরিবারের কোনও কথা গ্রহণ করেনি। থানা জানিয়েছে, ধৃত দু’জনের মোবাইল কললিস্ট চেক করা হয়েছে, তাতে কিশোরীর সঙ্গে যোগ থাকার কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাছাড়া অপহরণের ঘটনার কোনও সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি। যদিও সেখানে সিসিটিভি ছিল একাধিক জায়গায়।
এরপর স্বঘোষিত ‘হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষাকারী’ একদল লোক গত ১৫ জুন একটি সভার ডাক দিয়েছিল। যদিও শেষ মুহূর্তে তা বাতিল করা হয়। উত্তরাখণ্ড হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার নির্দেশ দিলেও এই ঘটনা থেকে উত্তেজনা ছড়ায়। বিবাহবন্ধনের মাধ্যমে হিন্দু মেয়েদেরকে ফাঁদে ফেলার ইসলামিক উপায় হিসাবে গুজব ছড়ানো লাভ জিহাদ নিয়ে সরব হওয়া লোকজন এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে গেল গেল রব তুলতে শুরু করেন। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয় যে পুরোলাতে মুসলিমরা এক প্রকার সামাজিক বয়কটের মুখোমুখি হন। হিন্দু ল্যান্ডলর্ডরা তাদের মুসলিম ভাড়াটিয়াদের উৎখাত করতে শুরু করেন। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে উত্তরাখণ্ডে আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ককে টার্গেট করার মতো অনেক ঘটনা ঘটেছে। তৈরি হওয়া পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এক আন্তঃধর্মীয় যুগল তাদের বিয়ে বাতিল করেন। যদিও তাদের পরিবারগুলোর এই সম্পর্কে কোনও আপত্তি ছিল না। সমাজ ও ধর্মের স্বার্থরক্ষা করার নাম করে গুন্ডারা হামলা করে বলে অভিযোগ। এই প্রবণতা আইনের শাসন এবং সামাজিক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড়সড় ঝুঁকি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।
পুরালা থানার ইনচার্জ খাজান চৌহানের মতে, ঘটনার দিন, নাবালিকা দুই অভিযুক্ত ২৪ বছর বয়সি উবেদ খান এবং ২৩ বছর বয়সি জিতেন্দ্র সাইনির সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা একটি পেট্রোল পাম্পের কাছে মূল বাজার এলাকা ছেড়ে একটি অটোরিকশা ডেকেছিল বলে অভিযোগ। স্থানীয়রা নাবালিকাকে অটোতে উঠতে দেখে তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে।
স্কুল শিক্ষক চাচা বলেছেন, মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি আমার সমর্থন প্রসারিত করতে চাই কিন্তু আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমি যখনই ফেসবুক খুলি, সংবাদ সম্পর্কিত বেশিরভাগ ভিডিয়োই বলে যে এটি লাভ জিহাদের ঘটনা ছিল। এটা আমার মন খারাপ করে। কেউ জিজ্ঞেস করে না আসল ঘটনা কী। ২৯ মে পুরোলায় হুমকিমূলক পোস্টার দেখা যায়, যাতে মুসলমানরা ১৫ জুনের মধ্যে যেন শহরটি খালি করে দেয়। প্রায় ৫০টি মুসলিম পরিবার শহর ছেড়েছে। যারা চলে গেছে, তাদের কখনোই ছেড়ে যাওয়া উচিত নয়। আমি তাদের ফিরে পেতে চাই। কিশোরীর চাচা আরও জানান, উবেদের ফার্নিচারের দোকান রয়েছে। তার কাছ থেকে ফার্নিচারও কিনেছি। তাকে বলেছিলাম, সেদিনকার ঘটনা কি হয়েছিল জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিতে। কিন্তু উবেদ রাজি হয়নি। হঠাৎ একটি গোষ্ঠী ও বাজার কমিটি তাদের ভয় দেখাতে শুরু করে। দেবভূমি রক্ষার নামে পথে বিদ্বেষ প্রচার হয়। অধিকাংশ মুসলিম পরিবার ঘরবাড়ি দোকান ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। সামান্য ঘটনায় উথালপাতাল অবস্থা হবে ভাবতেও পারছেন না তিনি। মুসলিমদের বিরুদ্ধে মহাপঞ্চায়েতের ডাক দেওয়া হয়। অথচ কিশোরীর অভিভাবক বলছেন, ঘটনাটিকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হিন্দু-মুসলিম করা হচ্ছে।