পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান তথা বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে কুস্তিগিরদের বিক্ষোভ ক্রমশই তীব্র আকার ধারণ করছে। এক কুস্তিগিরের অভিযোগ, ‘শারীরিক সম্পর্ক করলে আমাকে প্রোটিন সাল্পিমেন্ট কিনে দেবে বলেছিলেন ব্রিজভূষণ’। ওই স্বর্ণপদকজয়ী কুস্তিগির পুলিশকে জানিয়েছেন, কিভাবে ব্রিজভূষণ তার ঘরে ডেকে এনে তার অনুমতি ছাড়া তাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। তারপরেই তাকে বিছানায় আসার প্রস্তাব দেন।’
বিজেপি সাংসদ ও ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণকে নিয়ে এই ভাবেই মানসিক যন্ত্রণা উগড়ে দিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন ওই অলিম্পিক জয়ী কুস্তিগির। তিনি জানান, ঘটনার দিন জয়ের পর তিনি তার রেস্ট রুমে ছিলেন, ঠিক তখন তার ফিজিওথেরাপিস্ট তাকে বলেন, ব্রিজভূষণ তাঁকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন। তিনি ভেবেছিলেন, ব্রিজভূষণ তাকে শুভেচ্ছা জানাতে ডেকে পাঠিয়েছেন ভেবে, তাই তিনি তার ঘরে যান। কিন্তু ব্রিজভূষণের ঘরে যেতেই তাকে তার পাশে বিছানায় বসতে বলেন। আচমকাই তাকে জড়িয়ে ধরেন। তিনি ভয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন।
ওই কুস্তিগিরের আরও অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে যৌন হয়রানির কাজ চালিয়ে গেছেন, আর আমরা সব সময় তাঁর কাছ থেকে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম। স্বর্ণপদক জয়ের রাতেই তার শারীরিক নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছিল। সেই মানসিক যন্ত্রণা তিনি ভুলতে পারবেন না। তিনি পুরো বিষয়টাই তার মাকে জানিয়েছিলেন। এমনকী ব্রিজভূষণের ভয়ে মোবাইল নাম্বারও পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। এর পরেও রেহাই মেলেনি। মায়ের ফোনে ফোন করে তাকে বিরক্ত করতেন। বলেছিলেন, তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপণ করলে প্রোটিন সাপ্লিমেন্টগুলি তিনি কিনে দেবেন। ব্রিজভূষণের এই কর্মকাণ্ডের কারণে তিনি প্রায় একবছর ট্রমার মধ্যে ছিলেন। প্রশিক্ষণেও মনোযোগ দিতে পারেননি। তার অবস্থা এমন হয়েছিল যে, ব্রিজভূষণ যেখানেই যেতেন তিনি সেই জায়গাগুলি এড়িয়ে চলতেন। এতটাই তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, কোনও অনুষ্ঠানে তাকে (ব্রিজভূষণ) দেখতে পেলেই তিনি ভয়ে ভয়ে থাকতেন। স্বর্ণপদক জয়ী কুস্তিগিরের আরও অভিযোগ, অন্যান্য মহিলা কুস্তিগিরের সঙ্গে ব্রিজভূষণ একই ভাবে যৌন হয়রানি করতেন। ব্রিজভূষণের এই আচরণই অন্যান্যদের অভিযোগ দায়ের করতে প্ররোচিত করেছিল।
গত ২১ এপ্রিল দিল্লির কনট প্লেস থানায় সাতজনের মধ্যে এক কুস্তিগির এইভাবেই অভিযোগ জানিয়েছিলেন ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে। এই তৃতীয় অভিযোগকারিণী কুস্তিগিরের নাম গোপন রাখা হয়েছে। তার আগে গত ৭ মে প্রথম ও দ্বিতীয় কুস্তিগির থানায় ব্রিজভূষণের নামে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। টুর্নামেন্টে চলাকালীন ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে মোট আটটি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আপত্তিকর স্পর্শ ও শারীরিক সম্পর্ক স্থাপণের চেষ্টা। এই ঘটনাগুলি ঘটেছিল ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের কার্যালয়তেই।
এই বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে ১৫টি ঘটনার প্রেক্ষিতে শুক্রবার পুলিশ এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে আরও দু’টি এআরআর দায়ের করা হয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল দিল্লি পুলিশ এই এফআইআর নথিভুক্ত করেছে। অভিযোগ, সাহায্যের বিনিময়ে যৌনতা দাবি করতেন ব্রিজভূষণ। ১০টি ক্ষেত্রে কুস্তিগিরদের অনুপযুক্তভাবে স্পর্শ করার অভিযোগ রয়েছে বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে। স্তন থেকে নাভি স্পর্শ করার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
এদিকে অপর দুই অভিযোগকারি কুস্তিগিরের বক্তব্য, ব্রিজভূষণ শরণ সিং তাদের শ্বাস প্রশ্বাস পরীক্ষার অছিলায় তাদের বুক ও পেটে হাত দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় অভিযোগকারি কুস্তিগিরের কথায়, ২০১৮ সালে প্রশিক্ষণ চলাকালীন তার অনুমতি ছাড়া জার্সি তুলে শ্বাস-প্রশ্বাস দেখার অছিলায়, যৌন লালসা মেটাতে পেটে-স্তনে ইচ্ছাকৃত স্পর্শ!
অভিযোগকারিণীদের আরও অভিযোগ, ক্রীড়া মন্ত্রক কর্তৃক গঠিত তদারকি কমিটির তারা বিশ্বাস হারিয়েছে। এদিকে প্রাক্তন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বক্সার মেরি কমের নেতৃত্বে গঠিত তদারকি কমিটির ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।
অন্যদিকে যে বিজেপি সাংসদ, ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের দাবিতে অনড়। এমনকী এই টালমাটাল উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ব্রিজভূষণের বক্তব্য, ‘যদি আমার নামে একটাও অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তাহলে আমি নিজেকে ফাঁসিতে ঝোলাব’।
গত ২৩ এপ্রিল দেশের পদকজয়ী কুস্তিগির বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক, বিনেশ ফোগাট সহ অন্যান্যরা গত ২৩ এপ্রিল যন্তর-মন্তরের সামনে অবস্থান বিক্ষোভে বসেন। কিন্তু দিল্লি পুলিশ তাদের সেখান টেনে হিঁচড়ে তুল দেন। সাতজন মহিলা কুস্তিগির ২১ এপ্রিল সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, যার মধ্যে একজন নাবালিকাও ছিল। কুস্তিগিররা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার পরে পকসো আইনের অধীনে একটি সহ দুটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়েছিল। এর পরে কুস্তিগিররা হরিদ্বারের গঙ্গায় পদক ফেলে দিতে উদ্যত হলে কৃষক নেতা নরেশ টিকায়েতের নেতৃত্বে তারা তাদের সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে স্থগিত করলেও পাঁচদিনের মধ্যে কেন্দ্র সরকার এই প্রসঙ্গে কোনও সিদ্ধান্ত না নিলে পদক গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
এদিকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) এক বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, কুস্তিগিরদের নিরাপত্তা ও সুস্থতার কথা ভেবে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিৎ। অন্যদিকে দেশের প্রাক্তন অলিম্পিয়ান তথা বর্তমানে ইন্ডিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি(আইওএ) পিটি ঊষা আন্দোলনের প্রথম দিকে কুস্তিগিরদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘কুস্তিগিররা দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন’। পরের দিকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দিল্লির যন্তরমন্তরের সামনে সেই ধরনামঞ্চে গিয়ে প্রতিবাদীদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিলেন তিনি। আইওএ সভাপতি পিটি ঊষার মাধ্যমেই কুস্তিগিরদের নিরপেক্ষ বিচারের আবেদন করেছে আইওসি।