ট্রায়াল উড়ানেই ভেঙে পড়ছে একের পর এক যুদ্ধবিমান। গত ৫ বছরেই জেটবিমান দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক সেনা-জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। এখন চিন্তায় ফেলেছে মিগ, চিতা-র মতো পুরনো যুদ্ধবিমানগুলি।
বিশেষ প্রতিবেদক: মিগ-২১ জেট বিমান এবং চিতা বা চেতক— হেলিকপ্টারগুলোই হয়ে গেল সেনাবাহিনীর ‘কাল’। ৫ বছরে ৫০টি জেট বিমান আর হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত ৫৫ জন সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমানে বিমান বাহিনীর তিনটি মিগ-২১ স্কোয়াড্রন রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ৫০টি বিমান। গতবছর, আইএএফ মিগ-২১ ফাইটার স্কোয়াড্রনগুলির বিমান ধীরে ধীরে সরানোর জন্য তিন বছরের সময়সীমা চূড়ান্ত করেছিল। এখন, যুদ্ধ বিমান পর্যাপ্ত সংখ্যায় না আসার ফলে আইএএফ আগামী পাঁচ বছরে মিগ-২৯ ফাইটার জেটের তিনটি স্কোয়াড্রন পর্যায়ক্রমে শেষ করার পরিকল্পনা করেছে।
উল্লেখ্য, গত ছ’মাসে নতুন দেশীয় সশস্ত্র বাহিনীর অ্যাডভান্সড লাইট হেলিকপ্টার (ALH) চারটি বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। আর এর মধ্যেই ফের রাজস্থানে ভেঙে পড়ল মিগ ২১ যুদ্ধ বিমান। সূত্রের খবর, এ দিন একটি বাড়ির উপর ভেঙে পড়ে ওই ফাইটার জেট। দুর্ঘটনায় পাইলট অক্ষত থাকলেও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। এই ঘটনা শুধু দেশের সামরিক বিমান চলাচলকেই দুশ্চিন্তায় ফেলেনি, চিন্তায় ফেলেছে প্রশাসনকেও।
মাত্র পাঁচ বছরে ৫০টিরও বেশি বিমান ও হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রায় ৫৫ জন সামরিক কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। পুরনো মিগ-২১ বিমানের পাশাপাশি চিতা বা চেতক হেলিকপ্টারগুলি বছরের পর বছর ধরে অত্যন্ত বিপজ্জনক দুর্ঘটনার রেকর্ড গড়েছে। একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি একটি সর্বভারতীয় সংবাদপত্রকে বলেছেন, একক-ইঞ্জিন মেশিন চালিত মিগ-২১ এবং চিতা/চেতক হেলিকপ্টারগুলি প্রথম ১৯৬০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
বিমান বাহিনী তাদের সরানোর জন্য পর্যায়ক্রমে তিন বছরের সময়সীমা চূড়ান্ত করেছিল কিন্তু নতুন বিমানের অভাবে সশস্ত্র বাহিনী কী করতে পারে? সুরক্ষার অভাব, পাইলট-প্রযুক্তিবিদদের অপর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং তত্ত্বাবধান ও যন্ত্রাংশের মান নিয়ন্ত্রণের অভাব এই ধরনের দুর্ঘটনার হার বাড়িয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে প্রায় ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার জন্য ‘মানবীয় ত্রুটি’ (পাইলট/প্রযুক্তিগত) দায়ী, বাকি ১০ শতাংশ ‘পাখির আঘাত’ এবং অন্যান্য কারণে হয়।
সাবেক সোভিয়েত জমানার এই যুদ্ধবিমান এর আগেও একাধিকবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এর কারণেই ভারত সরকার ধীরে ধীরে এই বিমানের ব্যবহার কমাতে চাইছে বলে জানা গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬৬ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে ভারত মোট ৮৭২টি মিগ যুদ্ধবিমান কিনেছিল। ১৯৭১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ৪৮২টি বিমান ভেঙে পড়ে। এই দুর্ঘটনাগুলিতে ১৭১ জন পাইলট, ৩৯ জন সাধারণ মানুষ, ৮ জন সার্ভিসকর্মী, একজন এয়ার ক্রু প্রাণ হারিয়েছেন। ২০১৩ সাল থেকে ভারতে এই নিয়ে অন্তত ১১টি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে এই মিগ ও সুখোই যুদ্ধবিমান।
উল্লেখ্য, বিমান বাহিনীর আধুনিকীকরণ পরিকল্পনার অংশ হিসাবে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক ৮৩টি তেজস যুদ্ধবিমান কেনার জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেডের সঙ্গে ৪৮,০০০ কোটি টাকার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। বিমান বাহিনী তাদের যুদ্ধের সক্ষমতা বাড়াতে ফ্রান্স থেকে ৩৬টি রাফালে যুদ্ধবিমানও কিনেছে।
অন্যদিকে, গতবছরের মার্চ মাসে, প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অজয় ভাট রাজ্যসভায় বলেছিলেন যে, বিগত পাঁচ বছরে, সামরিক বাহিনীর তিনটি শাখায় (সেনা-বিমান বাহিনী এবং নৌ-বাহিনী) বিমান এবং হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ৪২ জন প্রতিরক্ষা কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।
২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বরে রাজস্থানের জয়সলমেরে ভেঙে পড়ে একটি মিগ-২১ যুদ্ধবিমান। ২০২১ সালেরই ২৩ আগস্ট রাজস্থানের বারমেঢ়ে ভেঙে পড়েছিল মিগ ২১ যুদ্ধবিমান। ২০১৬ সালের ১৩ জুনে যোধপুরের জনবহুল এলাকায় ভেঙে পড়ে মিগ ২৭ যুদ্ধবিমান। পাইলট অক্ষত অবস্থায় প্লেন থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও ঘটনায় তিনজন আহত হয়েছিলেন।
২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বারমেঢ় শহর থেকে হাফ কিলিমোটার দূরে শিবকর রোডে ভেঙে পড়ে মিগ ২৭ যুদ্ধবিমান। একজন বাইক আরোহী ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই বারমেঢ়ের উত্তরলাই এয়ারবেসে অবতরণের সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মিগ ২১ বাইসন যুদ্ধবিমান। ঘটনায় পাইলট মারা গিয়েছিলেন। ওই বছরই ৭ জুন বারমেঢ়েই ভেঙে পড়ে মিগ ২১ বাইসন যুদ্ধবিমান। পাইলট অক্ষত ছিলেন। ২০১৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বারমেঢ়ের উত্তলরলিয়া এয়ারবেসের খুব কাছে একটি গ্রামে ভেঙে পড়ে মিগ ২৭ যুদ্ধবিমান। রুটিন প্রশিক্ষণ উড়ানে গিয়েছিল বিমানটি। এই তালিকায় সম্প্রতি রাজস্থানের দুর্ঘটনাও যুক্ত হল।