ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে উদারতার সুগন্ধি। গান্ধীজীর সংযোজন ‘ঈশ্বর-আল্লাহ্ তেরো নাম’ গাইতে আপত্তি না থাকলেও এখন আপত্তি উঠছে আল্লামা ইকবালের লেখা কবিতা পাঠে ‘আল্লাহ্’ শব্দটি নিয়ে। এ সম্পর্কে তথ্যনির্ভর প্রতিবেদনটি লিখেছেন বিবেক কাটজু
বরেলির এক সরকারি স্কুলের অধ্যক্ষ নাহিদ সিদ্দিকিকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং মহম্মদ ইকবালের ‘লব পে আতি হ্যায় দুয়া’ পড়ুয়াদের গাওয়ানোর জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছে— এই বিষয়ে প্রতিবেদন পড়ে আমার মন গভীর দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। মিডিয়া রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্থানীয় কর্মকর্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ওই এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দাবি, ‘পড়ুয়াদের ধর্মান্তরিত করার জন্য’ এই ‘ধর্মীয় প্রার্থনা’ আবৃত্তি করানো হয়েছে। বরেলির বেসিক শিক্ষা অধিকারী বিনয় কুমার বলেন, যে প্রার্থনাসঙ্গীত আবৃত্তি করা হচ্ছিল তাতে ‘আল্লাহ ইবাদত করনা’ জাতীয় কথা ছিল। এটি নির্ধারিত প্রার্থনাসঙ্গীত নয় আর এই কারণে স্কুলের অধ্যক্ষ নাহিদ সিদ্দিকিকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’
এই অশুভ মেরুকরণের যুগে সিদ্দিকির বরখাস্তের মতো ক্রিয়াকলাপ নতুন কিছু নয়। শুভচিন্তকরা হয়তো কৃতজ্ঞই থাকবেন এই ভেবে যে, তাঁকে অন্তত শারীরিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। তাঁর চাকরি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাতিল করা হয়েছে। তাহলে আমার অনুভূতি এই শীতকালীন শৈত্যের মতো হয়ে রয়েছে কেন? ইকবালের কবিতা এক উদ্দীপক কারণ, ভালোর পথ অবলম্বন করতে এক শিশু ঈশ্বরের করুণা প্রার্থনা করছে। মানুষকে যত্ন নিতে, দরিদ্র ও দুর্বলের প্রতি সহমর্মিতা রাখতে, অন্ধকারের মধ্যে প্রসারিত হওয়ার মতো আলোর উৎস হয়ে উঠতে, দেশের বাগিচায় ফুল হয়ে ফুটে উঠতে, জ্ঞানের অনির্বাণ শিখাকে ভালবাসতে সে ঈশ্বরের দাক্ষিণ্য চাইছে। এই ধরনের ইচ্ছা ও প্রার্থনায় কোনও বিরোধিতা থাকতে পারে না, এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।
এই কবিতার শেষ স্তবকটি ‘আপত্তিকর’ যেখানে শিশু বলে, ‘মেরে আল্লাহ বুরাই সে বাচানা মুঝকো’, নেক জো রাহ হো উসি রাহ পর চালানা মুঝকো’। ‘রব’ ও ‘খুদায়া’ শব্দগুলিকে কেউ কেউ আপত্তিকর মনে করতে পারেন, যদিও এই শব্দগুলি কিছু হিন্দি বা হিন্দুস্তানী ভাষী মানুষ অহরহ ব্যবহার করে থাকেন। পাকিস্তানি আন্দোলনকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন ইকবাল এবং সংস্কারপন্থী ইসলামের সমর্থক ছিলেন। মুসলিম হওয়ার আগে তিনি ও তাঁর পরিবার ছিল কাশ্মীরি পণ্ডিত। আমি এটি জেনেছি আমার দাদু (নানা) ‘চাঁদে’র কাছ থেকে। তিনিও কাশ্মীরি পণ্ডিত। দেশভাগের সময় পর্যন্ত তাঁর পারিবারিক বাড়ি ছিল লাহোরে। দাদুও ছিলেন উর্দু কবি এবং একই সঙ্গে প্রশাসন বিভাগের কর্তা। ইকবালকে তিনি উস্তাদ মনে করতেন।
তিনি আমাকে বলেন, ইকবালকে তিনি নিজের লেখা দ্বিপদী শুনিয়েছিলেন— ‘উঠ গয়া পর্দা তো ফির মেহফিল না থা, লায়লা না থি/এক ফারাবি দিদ কো আপনা জাহান সমাঝ থা ম্যায়’।
এই কবিতা শুনে ইকবাল তাঁকে বলেছিলেন, গোটা বেদান্তের সংক্ষিপ্তসার ধরা পড়েছে এই লেখায় কারণ এই কবিতার অর্থ হল : এই বিশ্ব ভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। আমার দিদা (নানি) তেজ বাহাদুর সাপ্রুর কন্যা। তিনি আমাকে বলেন, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে ইকবালের পরিবার ছিল সাপ্রু। তিনি আরও জানান, ইকবাল যখন পাকিস্তানপন্থী হয়ে উঠছিলেন তখন তাঁর বাবা বকাবকি করেছিলেন তাঁকে কিন্তু ইকবালের উপর এর কোনও প্রভাব পড়েনি।
যাইহোক, যে বিষয় নিয়ে এখানে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ ইকবালের রাজনীতি বা তাঁর ‘দিওয়ান’ নয়। এই সুন্দর কবিতায় এক শিশু ভালোর পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে ঈশ্বরকে অনুরোধ করছে। ভারতের অন্যতম সেরা এক সরকারি স্কুলে পড়া এক বন্ধু আমাকে বললেন, এই কবিতাটি ছিল এক কবিতাগুচ্ছের অংশ এবং সেখান থেকেই এটি গাওয়া হয়েছে।
এই কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে স্কুলের কোনও পড়ুয়া ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। রোমান খ্রিস্টান মিশনারিদের পরিচালিত একটি স্কুলে আমি যেতাম। সেখানে দিনে দুইবার প্রভুর নামে প্রার্থনা করা হয়। সেই স্কুলের বেশিরভাগ পড়ুয়াই হিন্দু। মুসলিম, শিখও রয়েছে। সকলেই ওই একই প্রার্থনা করে নিয়মিত। তারপরেও কোনও অ-খ্রিস্টান শেষ পর্যন্ত খ্রিস্টান হয়ে যায়নি। সারা ভারতে খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত হাজার হাজার স্কুলে অসংখ্য পড়ুয়ারা যায় এবং সকলেরই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি কখনও শুনিনি, এই স্কুলে গিয়ে কেউ খ্রিস্টান হয়ে গিয়েছে।
তাহলে কোথায় থেকে এই ‘আল্লাহ’ বা ‘যিশুখ্রিস্ট’ শব্দের ব্যবহার নিয়ে ভয় সৃষ্টি হল? ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে হিন্দু সংস্কৃতি ও ধর্মের সহনশীলতা বিষয়ে। ইসলাম তাকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দিতে পারেনি যেমনটা অন্যত্র ঘটেছে। আমরা কেন এমন একটা পরিসরে এসে হাজির হলাম যেখানে আমাদের প্রাথমিক সভ্যতাগত নীতি ও উদারতা ক্ষয় পেতে বসেছে?
আল্লাহর নাম উল্লেখিত একটি প্রার্থনাসঙ্গীত কেন আমাদের এত আপত্তিকর ঠেকছে? আমাদের নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস ও ধর্মবিশ্বাস কি এতখানি ভঙ্গুর যে, কোনও কবিতায় আল্লাহর নাম থাকলেই তা বিরোধিতার যোগ্য হয়ে উঠবে? এমনটা ছিল না। এমনকি যখন ইন্দো-পার্সি সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব ছিল, অন্তত নাগরিক ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে, হিন্দুরা তখনও তাদের ধর্ম ও সভ্যতার জোরালো আবেদনের উপর বিশ্বাস রেখেছিল। এই ভাবেই আমি চিরকাল ইকবালের কবিতাকে ব্যাখ্যা করে এসেছি— ‘ইরান-ও-মিশর-ও-রোম সব মিট গয়া জাহান সে/কুছ বাত হ্যায় কি হাসতি মিট্টি নহি হ্যায় হামারি।’
মুসলিমরা কী করছে তা নিয়ে আমার তেমন মাথাব্যথা নেই এবং আমি ভাবি যে, বন্দে মাতরম নিয়ে তাদের বিরোধিতা কার্যত তাদের সভ্যতাগত নিরাপত্তাহীনতাকেই প্রকাশ করে দেয়। দুঃখের বিষয় হল, বদ্ধ ধারণা থেকে মুক্তি পেতে মুসলিমদের খুব কম শিক্ষিতজনই উদ্যোগ নেন। তবে, একজন গর্বিত হিন্দু হিসেবে আমার কাছে যেটি গুরুত্ব পায় সেটি হল, উদারতার সুগন্ধ যেন আমরা না হারিয়ে ফেলি। এটিই আমাদের ‘অথেনটিক’ বানিয়েছে এবং এটিই আমাদের সভ্যতাগত শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত রেখেছে। এবং এগুলি থেকে যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম হয় তা ভাষা, পোশাক ও সমসাময়িক নাট্যের অনেক উপরে।
অবশেষে, আমরা জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধিকে কীভাবে ভুলে থাকি? বিখ্যাত ভজন ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’কে তিনি বদলেছিলেন। এই পংক্তির মধ্যে তিনি যুক্ত করেছিলেন ‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম’। ডান্ডি মিছিলের সময় তিনি এটি করেছিলেন। এর ফলে অন্তত একজন দক্ষিণপন্থী লেখক গান্ধির এই সংযোজনের বিরোধিতা করেছিলেন এবং আমি তার পুনরাবৃত্তি করতে চাই না। কিন্তু এটি আজও অন্যতম ভজন। নানা অনুষ্ঠানে আজও গীত হয়ে থাকে। ২ অক্টোবর, গান্ধি জয়ন্তীতেও। এই ভজনের গান্ধি-সংস্করণ গাওয়ার জন্য আমরা কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে কি এফআইআর দায়ের করতে পারি এই দাবিতে যে, মূল ভজনে ‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম’ শব্দ ছিল না?
তরজমা : মুহাম্মদ জিয়াউল হক নস্কর