পুবের কলম প্রতিবেদক: ২০১৫-তে পেলে কলকাতায় দ্বিতীয়বার এসে নেতাজি ইন্ডোরে উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেকথা ভোলেননি মমতা। পেলের মৃত্যুতে শোকজ্ঞাপন করেছেন তিনি। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন, বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে থাকা কর্তাব্যক্তিরাও শোক জানিয়েছেন।
পেলের শেষকৃত্য হবে নতুন বছরের ২ জানুয়ারি। স্যান্তোস এফসির ঘরের মাঠ ভিলা বেলমিরোতে অনুষ্ঠিত হবে ‘ফুটবল সম্রাটে’র শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে প্রস্তুতি। ৩ জানুয়ারি সকাল পর্যন্ত চলবে অনুষ্ঠানটি। সাধারণ জনগণ ‘ফুটবলের রাজা’কে শেষশ্রদ্ধা জানাবে।
পেলের দাফন ৩ জানুয়ারি মেমোরিয়াল নেক্রোপোল ইকুমেনিকায় অনুষ্ঠিত হবে। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তির শেষকৃত্যে ব্যাপক ভিড় হবে বলে ধারণা। ব্রাজিলের ‘পোস্টার বয়’ নেইমার তাঁর ‘আদর্শে’র মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে লিখেছেন, ‘পেলের আগে ‘১০’ ছিল নিছকই একটি সংখ্যা। এই বাক্যাংশটি আমি জীবনে কোনও এক সময় কোথাও একটা পড়েছিলাম।
এই বাক্যটি সুন্দর হলেও সম্পূর্ণ নয়। পেলের আগে ফুটবল ছিল একটি খেলা। পেলে বদলে দিলেন সবকিছু। ফুটবলকে শিল্প ও বিনোদনে পরিণত করেছিলেন তিনি। গরিব ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কণ্ঠ ছিলেন। ব্রাজিলকে গোটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। ফুটবল এবং ব্রাজিল তার মর্যাদা বাড়িয়েছে। ধন্যবাদ রাজাকে তিনি চলে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁর জাদু রয়ে গিয়েছে। পেলে চিরন্তন।’ নেইমারের উদ্ধৃতির নির্যাস নিয়ে বলতে হয়, পা দিয়ে স্বরলিপি লিখতেন পেলে। সবুজ ঘাস বিছানো ফুটবলমাঠে। ২২ বছর আগে অর্থাৎ ২০০০ সালে ফিফা যখন তাঁকে ‘শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়’ নির্বাচিত করল, তাঁর চোখে তখনও ছিল প্রত্যয়ের দৃষ্টি।
যেমনটা ফুটবলার থাকাকালীন থাকত। পেলে একটা অধ্যায়, একটা মহাকাব্য, একটা রূপকথা, গ্লোবাল এক ক্রীড়াব্যক্তিত্বর নাম। ৮২ বছর বয়সে তিনি আজ চিরনিদ্রায় শায়িত। স্বাভাবিকভাবেই মনখারাপ তাঁর ভক্তদের। কোলন ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। শেষরক্ষা হল না। সাও পাওলোর হাসপাতালে চিকিৎসকদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ব্রাজিল দলের জার্সি গায়ে ৯২ ম্যাচে ৭৭ গোলের মালিক পা রাখলেন অনন্তলোকে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ফুটবল সম্রাট’-এর মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন তাঁর মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো। তিনি ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘আমরা যা কিছু হয়েছি, তোমার কারণেই। তোমাকে অনেক ভালোবাসি। শান্তিতে ঘুমাও।’
২৯ নভেম্বর সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। কেমোথেরাপির মাধ্যমে তাঁর চিকিৎসা করা হলেও কোনও সুফল পাওয়া যাচ্ছিল না। এরপর কেমোথেরাপি বন্ধ করে তাঁকে ব্যথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়। এ ছাড়াও তাঁর কিডনি ও কার্ডিয়াক ডিসফাংশন ছিল। পেলের মৃত্যুর পর ব্রাজিল সরকার তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে। এই তো কদিন আগেই হাসপাতালে পেলের সঙ্গে বড়দিন উদ্যাপন করেছিল তাঁর পরিবার। এখন সেসব সুখস্মৃতি।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কোলন টিউমার অপসারণ করা হয়েছিল তাঁর। চিকিৎসকরা বুঝতে পারেননি, টিউমারটি অন্যান্য অঙ্গেও ছড়িয়ে পড়বে। পেলের আসল নাম এডসন আরন্তেস দো নাসিমেন্তো। ডাক নামগুলি হল ডিকো,পেলে এবং দ্য ব্ল্যাক পার্ল। পেলের জন্ম ২৩ অক্টোবর, ১৯৪০ সালে ব্রাজিলের ট্রেস কোরাসোয়েসে। তিনি ছিলেন সর্বকালের সেরা ফুটবল খেলোয়াড়দের একজন। চারটি বিশ্বকাপ খেলেছেন পেলে। এর মধ্যে তিনবার, ১৯৫৮, ১৯৬২ এবং ১৯৭০ সালে, বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। ১৯৭১ সালে ব্রাজিল জাতীয় দল থেকে অবসর নেন পেলে।
প্রবল দারিদ্র ঘরে মধ্যে বেড়ে ওঠা পেলে ফুটবলে অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। এমন রেকর্ড রয়েছে তাঁর নামে, যা আজ পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেননি। পেলেই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি তাঁর দেশের হয়ে তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছেন। বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে ১৮ বছর বয়সের আগে ফিফা বিশ্বকাপে গোল করেন তিনি। এমনই ‘সেনসেশন’ ছিলেন তিনি। মাত্র ১৭ বছর ২৩৯ দিন বয়সে ১৯৫৮-র বিশ্বকাপে ওয়েলসের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচে তাঁর প্রথম বিশ্বকাপ গোল করেন। এইভাবে তিনি এই টুর্নামেন্টে সবচেয়ে কম বয়সি ফুটবলার হিসেবে গোল করে কৃতিত্ব গড়েন। বিশেষ বিষয় হল, ১৭ বছর ২৪৪ দিন বয়সে তিনি ’৫৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকও করেছিলেন। তিনি বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক করা সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়ও। ফাইনালে জোড়া গোল করে ব্রাজিলকে বিশ্বকাপ জেতান তিনি। কীর্তিই যে মানুষকে অমর করে তাঁর প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ পেলে।