পুবের কলম, ওয়েবডেস্ক: নৃশংসতা যে এত ভয়াবহ হতে পারে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। পরিকল্পনা মাফিক খুন! টিভি সিরিয়াল দেখে খুনের ফঁন্দি, তার পর সঙ্গিনীর দেহের ৩৫টি টুকরো করে নতুন কেনা ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখল পুরুষ সঙ্গী। গভীর রাতের অন্ধকারে সবার অলক্ষ্যে সেই দেহ জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে লাগল সে। ঘরের পচা গন্ধ দূর করার জন্য জ্বালিয়ে রাখল ধূপ। দীর্ঘ পাঁচ মাস অভিযুক্ত সেই বাড়িতেই কাটিয়ে দিল, যেখানে সে নিজের হাতে তার সঙ্গিনীর দেহের ৩৫টি টুকরো করল নিখুঁতভাবে।
লিভ ইন পার্টনারের দেহ ৩৫টি টুকরো করে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দেওয়ার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে অভিযুক্ত যুবক আফতাব আমিন পুনাওয়ালা। খোদ রাজধানী দিল্লির বুকে এই ধরনের হাড়হিম করা নৃশংসতার ভয়াবহতায় শিউরে উঠেছে গোটা সমাজ। মৃতা শ্রদ্ধা ওয়াকারের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে গত শনিবার ২৮ বছর বয়সী যুবক আফতাব আমিন পুনাওয়ালাকে গ্রেফতার করে দিল্লির মেহরাউলি পুলিশ। অপরাধ করার পাঁচ মাসের মাথায় এই ঘটনা প্রকাশ্যে এল।
২৬ বছরের তরুণী শ্রদ্ধা ওয়াকারের সঙ্গে লিভ-ইনে থাকত আফতাব। দুজনের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল বলে পুলিশ সূত্রে খবর। শুধু খুন করেই খান্ত হয়নি অভিযুক্ত, প্রেমিকার দেহ ৩৫টি টুকরো করে দিল্লির মেহরাউলির জঙ্গল সহ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছিল সে। প্রতিদিন রাত ২টোয় সে দেহের টুকরোগুলিকে নিয়ে বের হত। দেহ রাখার জন্য সে নতুন একটি ফ্রিজ ও ঘরে গন্ধ না বের হওয়ার জন্য ধূপ জ্বালিয়ে রাখত।
ঘটনার পাঁচ মাস পরে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে আফতাব। তা পরেই শনিবার গ্রেফতার করা হয় তাকে। ধৃত আফতাব আমিন পুনাওয়ালাকে পাঁচ দিন পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। অভিযুক্ত পুলিশকে জানিয়েছে, এই ঘটনায় ‘ডেক্সটার’ নামক একটি টিভি শো দেখে সে খুনের ফন্দি আঁটে। সেখানে দেখানো হয়েছে, নায়ক একজন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ অন্যদিকে একজন সতর্ক সিরিয়াল কিলার, দুটি সত্ত্বাই সে জীবনে সমান্তরালভাবে পালন করছে।
বার বার বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ার জন্য শ্রদ্ধাকে এত নৃশংসভাবে খুন করে আফতাব। বিয়ে নিয়ে দুজনের মধ্যে অশান্তি লেগেই থাকত। গত ১৮ মে দুজনের মধ্যে অশান্তি চরমে ওঠে। এর পরেই আফতাব প্রথমে তার প্রেমিকা শ্রদ্ধাকে শ্বাসরোধ করে খুন করে। তার পরে শ্রদ্ধার দেহ একটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে ৩৫টি টুকরো করে একটি ফ্রিজের মধ্যে সেই টুকরো করা দেহের অংশগুলিকে ঢুকিয়ে রাখে সে। প্রায় ১৬ দিন ধরে দিল্লির বিভিন্ন স্থানে দেহের সেই টুকরোগুলিকে ফেলতে থাকে সে।
এদিকে মেয়ের খোঁজ না পেয়ে বাবা বিকাশ মদন ওয়াকার গত ৮ নভেম্বর শ্রদ্ধার নামে অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন দিল্লির মেহরাউলি থানায়। বিকাশ পুলিশকে জানান, মহারাষ্ট্রের পালঘরে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে থাকেন। শ্রদ্ধা মুম্বাইতে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে কল সেন্টারে কাজ করত। সেখানেই তার আলাপ হয় আফতাব আমিন পুনাওয়ালার সঙ্গে। দুজনের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে, এর পর শ্রদ্ধা লিভ ইনে আফতাবের সঙ্গে দিল্লিতে থাকতে শুরু করে। মেয়ের এই কর্মকাণ্ড কোনোদিনই পরিবারের তরফ থেকে মেনে নেওয়া হয়নি। বাড়ির অমতেই আফতাবের সঙ্গে শ্রদ্ধা একটি ভাড়ার ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে শুরু করে দিল্লির ছতারপুর এলাকায়। বিকাশ পুলিশকে জানিয়েছেন, চলতি বছরের ২২ মে থেকে তার সঙ্গে মেয়ের আর কোনও কথা হয়নি। মেয়ে আর বাবার মধ্যে পুরোপুরি যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফোনটিও সুইচ অফ বলছিল।
অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে, পাঁচ মাস আগে খুন হয়ে গেছে শ্রদ্ধা। ছতারপুরের ফ্ল্যাট থেকেই পুলিশ আফতাব আমিন পুনাওয়ালাকে প্রথমে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। প্রথমে সব ঘটনা এড়িয়ে গেলেও পুলিশের জেরার মুখে কার্যত ভেঙে পড়ে শ্রদ্ধাকে নৃশংসভাবে খুনের কথা স্বীকার করে আফতাব। যেখানে শ্রদ্ধার দেহের টুকরোগুলি ফেলা হয়েছিল সেখানে গিয়ে পুলিশ তল্লাশি শুরু করেছে।
ঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি হাড় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সেটি শ্রদ্ধার কিনা তা এখনও নিশ্চিভাবে জানাতে পারেনি পুলিশ। পাওয়া যায়নি ঘাতক ছুরিটিও। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্ত যুবক আফতাব আমিন পুনাওয়ালা একজন প্রশিক্ষিত শেফ। তাই হয়তো দেহ টুকরো করতে তার কোনও অসুবিধা হয়নি।
পুলিশকে আফতাব জানিয়েছে, সে মানবদেহের ব্যবচ্ছেদ, শরীর থেকে রক্ত কিভাবে পরিষ্কার করতে হবে তা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সে গুগল থেকে সার্চ করে পেয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, গত ১৮ মে শ্রদ্ধাকে খুন করে আফতাব। তার পরে সে দেহ লোপাটের কাজ সম্পূর্ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী করে। শরীর ব্যবচ্ছেদ নিয়ে সে বিস্তারিত পড়াশোনা করে ইন্টারনেট থেকে। পুলিশ তার বাড়ি থেকে এই সম্পর্কিত একটি ইলেকট্রনিক গেজেট বাজেয়াপ্ত করেছে। গেজেট আর গুগুল সার্চে হিস্ট্রিতে অনুসন্ধান চালিয়ে পুলিশ আফতাবের বয়ান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, শ্রদ্ধাকে খুন করে পর দেহের ৩৫টি টুকরো করার পর, সেগুলোকে বাথরুমে নিয়ে যায় সে। তার পর একটি কেমিক্যাল দিয়ে রক্তের সব দাগ পরিষ্কার করে মেঝে থেকে। তার পর সামনের একটি দোকান থেকে একটি ফ্রিজ কিনে আনে। দেহের টুকরোগুলি থেকে রক্ত পরিষ্কার করে সে ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত ডেপুটি পুলিশ কমিশনার(ডিসিপি) সাউথ অঙ্কিত চৌহান জানিয়েছেন, শ্রদ্ধা মুম্বইয়ে কাজ করার সময়ে তার সঙ্গে একটি ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রথমে তিনবছর ধরে লিভ-ইন থাকার দুবছর পর দিল্লিতে চলে আসে তারা। শ্রদ্ধা আফতাবকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিতে থাকে। এই নিয়ে দুজনের মধ্যে অশান্তি শুরু হয়। গত ১৮ মে এই অশান্তি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায়। ওই দিনই শ্রদ্ধাকে খুন করে আফতাব।
পুলিশ সূত্রে খবর, যে ঘরে শ্রদ্ধাকে খুন করে ফ্রিজের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছিল আফতাব, সে ঘরেই রাতে ঘুমোত সে। মাঝেমধ্যে সে শ্রদ্ধার কাটা মুখটি ফ্রিজ থেকে বের করে দেখত।
এর পর সে নিয়ম করে ফ্রিজটিকে পরিষ্কার করত। জানা গেছে, শ্রদ্ধা ছাড়াও বহু মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল আফতাবের। অপরাধ, আমেরিকান অপরাধ মূলক নাটক, ওয়েব সিরিজ দেখতে ভালোবাসত।
পুলিশ আফতাবের বাড়ি থেকে কয়েকটি হাড়ের টুকরো উদ্ধার করেছে। আইপিসির ৩০২ ধারায় আফতাবের বিরুদ্ধে খুন, ২০১ ধারায় তথ্য লোপাট করার মামলা দায়ের করেছে দিল্লির মেহরাউলি থানার পুলিশ।
দিল্লির মহিলা কমিশনের প্রধান স্বাতী মালিওয়াল এক ট্যুইট বার্তায় জানিয়েছেন, ‘কি ধরনের দানবরা এই সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ধরনের অভিযুক্তের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিৎ।’