বিশেষ প্রতিবেদকঃ আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত সম্প্রতি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সম্প্রদায় মুসলিমদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছেন। এর আগে অবশ্য তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের মাওলানা আরশাদ মাদানীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন।
মোহন ভাগবত আপাতত দুই পর্যায়ে মুসলিমদের সঙ্গে ডায়লগে বসেছেন। প্রথমে তিনি পাঁচজন মুসলিম বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। এঁরা হচ্ছেন ইলেকশন কমিশনের পূর্বতন প্রধান এস ওয়াই কুরেশি, দিল্লির প্রাক্তন গভর্নর নাজির জঙ্গ, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য লে. জেনারেল জামিরউদ্দিন শাহ, প্রাক্তন সাংসদ ও সম্পাদক শাহিদ সিদ্দিকী এবং ব্যবসায়ী ও সমাজকর্মী সাইদ শেরওয়ানী।
সূত্র মোতাবেক, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে যা আলোচনা করেন তা ছিল সংঘের ধ্যান-ধারণা তুলে ধরা এবং ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্যের প্রসার। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা, যেমন জ্ঞানভাপী মসজিদ, হিজাব বিতর্ক এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণও বৈঠকে আলোচিত হয়।
এস ওয়াই কুরেশি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আরএসএস প্রধান বর্তমানে দেশে যে অনৈক্যের পরিবেশ গড়ে উঠেছে তা নিয়ে চিন্তা ব্যক্ত করেন। গত আগস্টে ভাগবত বলেছিলেন যে, প্রতিটি মসজিদে শিবলিঙ্গ খোঁজার প্রয়োজন নেই। এবং এইসব ইস্যুতে আরএসএস কোনও আন্দোলন চায় না। ভাগবত নাকি এও বলেন, কিছু বিষয় তাঁকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে রেখেছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে গরু হত্যা। ওই মুসলিম প্রতিনিধি দল তাঁকে বলেন, প্রায় সারা ভারতেই গরু জবাই বন্ধ। কেউ যদি আইন ভাঙে তবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া ভাগবতের মতে, কাফির শধের ব্যবহারও হিন্দুদের আহত করে থাকে।
এস ওয়াই কুরেশি বলেন আমরা তাঁকে বলি, আরবিতে কাফির শধের অর্থ ‘অবিশ্বাসী’। এটা একটি নিরপেক্ষ শব্দ ছিল। কিন্তু বর্তমানে তা নেতিবাচক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা বলেন, কিছু ডানপন্থী গ্রুপ মুসলিমদের জেহাদি, পাকিস্তানি— এসব বলে অভিহিত করে। তারা মুসলিমদের দেশের প্রতি বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রেও প্রশ্ন তোলে। তারা চায় মুসলিমরা পদে পদে তাদের দেশাত্মবোধের পরিচয় দিক। আরএসএস প্রধান উত্তরে বলেন, মুসলিমরা ভারতীয় এবং আমাদের ও তাদের ডিএনএ এক। দেশের বেশিরভাগ মুসলিমই হচ্ছে ধর্মান্তরিত।
মোহন ভাগবত বৃহস্পতিবার দিল্লির একটি মসজিদে যান এবং তিনি সর্বভারতীয় ইমাম সংগঠন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি উমার আহমেদ ইলিয়াসি ও অন্যান্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেন। এই প্রথম আরএসএসের কোনও ‘সর সঞ্চালক’ একটি মসজিদে প্রবেশ করলেন। সেখানে উমার ইলিয়াসি মোহন ভাগবতকে রাষ্ট্রপিতা বলে সম্বোধন করেন। তাঁকে এখানে ‘রাষ্ট্রঋষি’ও বলা হয়। এই বৈঠকে ভাগবতের সঙ্গে ছিলেন আরএসএসের জয়েন্ট সেক্রেটারি কৃষ্ণ গোপাল এবং ইন্দ্রেশ কুমার।
হঠাৎ মুসলিমদের সঙ্গে সংলাপ করার যে উদ্যোগ আরএসএস নিয়েছে তাকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন। তবে সাংসদ আসাদউদ্দিন ওয়েসির মতো নেতারা বলছেন, মোহন ভাগবত কয়েকজন এলিট মুসলিমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যাদের মুসলিম সমাজের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। আসাদউদ্দিন ওয়েসি আরও বলেন, সারা পৃথিবী আরএসএসের ইতিহাস ও আদর্শ জানে। আসাদউদ্দিন ওয়েসি বলেছেন, প্রকৃত মুসলিম নেতৃত্বের সঙ্গে আরএসএস সংলাপ না করে নিজেদের পছ¨মতো সংগঠন বা ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলছেন। তবে এটা একটা গণতান্ত্রিক অধিকার। এতে অসুবিধা কিছু নেই।
এ দিকে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সম্প্রতি বিজেপি সরকার এবং আরএসএসের শাখা সংগঠনগুলি সংখ্যালঘুদের নিশানা করে যেসব কাজ করেছে, তা ভারত ও বিদেশেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যেমন, নবী সা.-র অবমাননা, বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের মাদ্রাসা এবং ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া, মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরতে নিষেধ, নানা অজুহাত দেখিয়ে মুসলিমদের লিঞ্চিং, জ্ঞানভাপী-সহ আরও কয়েকটি মসজিদ বাবরির কায়দায় দখলের চেষ্টা ইত্যাদি বেশ কিছু পদক্ষেপ।
এই প্রেক্ষিতে আরএসএস প্রধানের বর্তমান উদ্যোগকে ওয়াকিফহাল মহল বলছেন, মুসলিমদের প্রবোধ দেওয়ার প্রচেষ্টা হতে পারে। আবার বর্তমানে আরএসএস, বিজেপি ও সংঘ পরিবারের যে ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে, মোহন ভাগবত হয়তো তাও খানিকটা পুনরুদ্ধার করতে চান।