দেবশ্রী মজুমদার, পাঁড়ুই: জ্বালানির অগ্নিমূল্যেব যখন গণপরিবহন বেসামাল, ঠিক তখনই গরীবের ঘোড়া রোগ পাঁড়ুইয়ের এক শিল্পীর। শিল্পী উদয় দাস তাঁর মা লক্ষ্মীর নামে নিজেই বানিয়ে ফেললেন “লক্ষ্মী ট্র্যা ভেলস” বাস। শুরুতে এমন মন্তব্য গ্রামের অনেকেই করেছিলেন। অবশ্যষ যতক্ষণ না কোনও রূপকথার কাহিনির মতো তার বাস সজীব হয়ে জ্বালানির তেল দাবি করছে! ততক্ষণ নো চিন্তা বাস মালিকের! এটাই যা আশার কথা!
বাসের রুট বোলপুর শান্তিনিকেতন বাইপাস রোড। রাজ্যু সরকারের নিয়মে করোনাবিধি মেনে পঞ্চাশ শতাংশ যাত্রী নিয়ে দূরত্ববিধি মেনে চলতে হবে বাস। বোলপুর শান্তিনিকেতন ছেড়ে কসবা পাঁড়ুই হয়ে সিউড়ী যাবে বাস। রিজার্ভ করা যাবে। কন্টাক্ট নম্বর দেওয়া আছে বাসের গায়ে।
বাস তো হল, কিন্তু তেলের যা দাম! তবুও এই খেয়াল! শিল্পী মাত্রেই খেয়ালী, আর শিল্প মানেই খামখেয়ালের ফসল।
এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে পাঁড়ুই পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ধানাই গ্রামে যেতে হবে। পাঁড়ুই থেকে মাত্র এক কিমি হাঁটা পথ।
ব্যা ঙ্ক থেকে আশি হাজার টাকা লোন নিয়ে একা হাতে নিখুঁত বাসের আদলে তৈরি করে ফেলেন এক আস্ত বাসা। দূর থেকে সাধারণ মানুষের মনে হবে বাস দাঁড়িয়ে আছে প্যা সেঞ্জার নেওয়ার জন্যস। পাক্কা এক বছর লাগে। তাঁকে সাহায্য করেছেন স্ত্রী আর বড় ছেলে। দুএকজন শ্রমিক ছাড়া পুরো কাজটা নিজে একা হাতে করেছেন। এমনিতে মৃৎ শিল্পী। পুরন্দরপুরে পঁয়তাল্লিশ ফুট কালী মূর্তি তিনি তৈরি করেন। পড়াশোনা করা হয়নি। তাই বিশ্বভারতীর কলাভবনে পড়ার সাধ তাঁর মেটেনি। কৃষিমেলায় তাঁর শিল্প সকলের নজর কাড়ে। পুরস্কারও পান। তবে অভাব তাঁর নিত্যিসঙ্গী। শিল্পী ভাতা পান নি। পান নি অন্যাুন্য সাহায্য।
প্রথম যখন বাসা বানাতে গিয়ে বাস বানাচ্ছিলেন, অনেকেই ভাবছিলেন একি ছেলেখেলা! আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে বাস খঁজতে সবাই চলে আসছেন, রসিকতা করে বলছেন, বাসে চড়তে এলাম। দাদা, বাস কখন ছাড়বে?
সবার তারিফ শুনে উদয় দাস বলেন, সবাইকে আনন্দ দিতে পারছি এতেই আনন্দ। এখনও গৃহপ্রবেশ হয় নি। তবে বাইরে ওয়েদার কোট পেন্টিং, জানালার কাঁচ লাগানো সম্পূর্ণ। দূরদূরান্তের লোকের কাছে এখন পরিচিত শিল্পীর গ্রাম ধানাই গ্রাম। বাসের আদলে বাসা দেখতে ভিড় জমছে মানুষের। এখন পোড়ো ভগ্নপ্রায় বাড়িতে বড় ছেলের পরিবার, ছোট ছেলে, স্ত্রী ও অসুস্থ মা বাবাকে নিয়ে মাত্র দুটি রুমে থাকেন উদয় দাস। দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এক ছেলে ও মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন।
বাস বাড়ি। অথচ বাস বলে ভুল হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি আছে। বাসের রঙ, বাসের জানালা, বাসের ঘেরা ছাদ, বাসের মুখ, হেড লাইট, বাসের চাকা এত নিখুঁত যা একমাএ কোন শিল্পীর পক্ষে এমনভাবে প্রাণবন্ত করে তোলা সম্ভব। চাকায় নাটবোল্ট পর্যন্ত আসল মনে হবে। শিল্পীর কথায়, ঢালাই দিয়ে চাকা তৈরি হয়। তারপর ছোট কুর্ণি দিয়ে সিমেন্টের মশলা ধরিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় বাসের চাকা। শুধু তাই নয় বাসের গায়ে যেসব লেখা থাকে তাও হুবহু লেখা রয়েছে। বাসের ভেতরে ঢুকলে একটি রান্নাঘর ও একটি বেডরুম আছে। কিন্তু রান্নাঘর পুরো বাসের কেবিন। কেবিনের দেওয়ালে শিবের মূর্তি। বাসা মনে হবে না। মনে হবে যেন বাসেই আছি। গন্তব্যস্থল চলে এলো না তো?
খালাসী যেন হাঁক মারছে– পাঁড়ুই, কসবা, সিড়ড়ী…