ওবাইদুল্লা লস্কর, ডায়মন্ডহারবার, আমি এখন ইতিহাসের পাতা ওল্টাচ্ছি । কবর থেকে উঠে আসা জ্যান্ত ভূতের মামলা দেখছি । ফিরে যাই ১৮৭৩ সালের সেই গা ছম ছম করা এক ঐতিহাসিক মামলায় । বংশ ,অংশ ,দ্বন্দ্ব এমন এক ঐতিহাসিক মামলা নিয়ে আজকের এই প্রসঙ্গ । তখন ভারতবর্ষে কলকাতা হাইকোর্ট বিল্ডিং তৈরির কাজ সবে শেষ হয়েছে , সাল ১৮৭২,পয়লা জুলাই । আর এই মামলা শুরু হয় ঠিক ওই সালে অর্থাৎ ১৮৭২ ,২১ শে জুন । সেই শুরু থেকে ইতিহাসের পথ ধরে আজও হুগলি নদী বয়ে চলেছে সেই মামলা । এই মামলার নথিতে জড়িয়ে আছে লোকমাতা রাণী রাসমণি এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির ।
লোকমাতা রাণী রাসমণি অপর্ণনামা করেছিলেন তাঁর আট নাতির নামে । জমিদারী ভাগের সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের সেবাইতও হয় ওই আট জনই । তারা হচ্ছেন পদ্মমনি দাসী, স্বামী রাম চন্দ্র দাসের তিন ছেলে ১ গনেশ দাস , ২ বলরাম দাস, ৩ সীতা নাথ দাস । মৃত কুমারী চৌধুরী,স্বামী পিয়ারি মোহন চৌধুরীর এক ছেলে ৪ যদুনাথ চৌধুরি । করুনাময়ী বিশ্বাস, স্বামী মথুর মোহন বিশ্বাসের এক ছেলে ৫ ভূপাল চন্দ্র বিশ্বাস ।
জগদম্বা বিশ্বাস ,স্বামী মথুর মোহন বিশ্বাসের তিন ছেলে ,৬ দ্বারিক নাথ বিশ্বাস ,৭ ত্রৈলক্য নাথ বিশ্বাস, ৮ ঠাকুর দাস বিশ্বাস ।
এই চার মেয়ের আট নাতি । করুনাময়ী অকালে মারা গেলে রানি মাতার ছোটো মেয়ে জগদম্বাকে মথুর মোহন আবার বিয়ে করেন রানি মাতার আদেশে ।
এই অপর্ণনামা লেখা হয়েছিল রাণী রাসমণিমাতার বয়ান অনুসারে ১৮ ই ফেব্রুয়ারি, ১৮৬১ সালে । রেজিষ্ট্রি হয় আলিপুর ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্টি অফিস আলিপুরে ২৭ শে আগষ্ট ১৮৬১ সালে । এই অপর্ণনামা লিখেছিলেন মোক্তার প্রসন্ন চন্দ্র বোস । এই অপর্ণনামা তাঁর সই আছে ঠিক এভাবে’ শ্রী রাষমনি দাসী ‘।
এই অপর্ণনামার ইসাদি অর্থাৎ সাক্ষীগণ ছিলেন ছয় জন ,১ কন্ঠ দত্ত ,২ হরি ঘোষ ,৩ অন্তশা প্রসাদ চট্রোপাধ্যায় ,৪ প্রসন্ন চত্রুবর্তী ,৫ দুর্গা প্রসাদ মান্না ,৬ রামচন্দ্র বসু পুরোহিত ।
এই অপর্ণনামা অনুসারে তিনি নিজেই ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রথম সেবায়েত। অপর্ণনামা রেজিষ্ট্রি হয় তাঁর মৃত্যুর ঠিক ছয় মাস পরে অর্থাৎ ১৯ শে ফেব্রুয়ারি ১৮৬১ সালে । অপর্ণনামায় যা লেখা আছে নিখুঁতভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি ।
৩১ মে ,১৮৫৫ সালে স্নান যাত্রা উপলক্ষ্যে দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে প্রথম পূজা হয় । প্রথম পুরোহিত ছিলেন রাম কুমার চট্রোপাধ্যায় ,রামকৃষ্ণদেবের দাদা । পরে গদাধর অর্থাৎ রামকৃষ্ণদেব এসেছিলেন । তাঁর সাহায্য করতেন তাঁর ভাগ্নে হৃদয় ।
এইবার আসি মামলা প্রসঙ্গে ধর্মের দেশে ধর্ম ব্যবসা জম জমাট হয় এটা সবাই জানে । যত বেশি তীর্থযাত্রী, তত বেশী আয় হয় আর যত বেশী আয় হয়, তত বেশী দ্বন্দ্ব বাঁধে ওই আট সেবাইতদের মধ্যে । এই হচ্ছে মোকদ্দমা উৎস । কেস নম্বর সি এস ৩০৮ /১৮৭২ – পদ্মমনি দাসী এবং অন্যান্য বনাম জগদম্বা দাসী
এবং অন্যান্য ।
জানবাজার জমিদার বাড়ি , দক্ষিণেশ্বর কালিমন্দির রেনেসাঁসের পীঠস্থানেও মামলার বোঝা ! স্বর্গেও ছুঁচোর কীর্তন । জমিদারীর কৌলিন্য (জেলে সম্প্রদায়) , ব্রাহ্মণের ছোঁয়া ,কায়স্থের ভালোবাসা এক মিলন মেলার পূণ্যভূমি হয়ে ওঠে । স্বামী বিবেকানন্দের স্পর্শে আন্তর্জাতিক বহিঃপ্রকাশের বিহ্বলতা বিস্ময় জাগায় ।
এমন জায়গা থেকে ফিরে যেতে হয় উচ্চ ন্যায়ালয়ে বিচার পেতে । এটাকে অনেকে স্বর্গ থেকে নরক যাত্রা বলে ।
এই ধর্ম মামলার পিছনে আছে যত অধর্মের লোভী কাহিনী । লোভ ,হিংসা ,প্রতিহিংসার চরিতার্থের জটিল কাহিনী । রানিমাতার স্বপ্নের সমাধি বলা যায় । এ মামলার সাক্ষী শুধু পাঠকগণ নয় , ভক্তবৃন্দ থেকে শুরু করে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব ,স্বামী বিবেকানন্দ । তবুও ঠাকুর ঘরের দ্বন্দ্ব ঠাকুর ঘরে মিটল না । দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির থেকে বের হয়ে সোজা কলিকাতা হাইকোর্টের মহাধর্মাধিকরণের কাঠগড়ায় এখন দাঁড়িয়ে আছে ; বাঙালির হাইকোর্ট দেখানো যাকে বলে । তৎকালীন ইংরেজ বিচারক ম্যাকফারসনের সরস মন্তব্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ ।
‘রাসমনির উত্তর রাসমনির
He (the collector of parganas ) preferred the plaintiffs ( padmamoni and others ) to the civil court to establish the right which they asserted .
কলেক্টরের এই রায়ের বিরুদ্ধে পদ্মমনি প্রেসিডেন্সী ডিভিশনের কমিশনের নিকট আবেদন করেন । কমিশনার সাহেব কলেক্টরের আদেশকে বাতিল করে পদ্মমনি সহ বাদীদের নাম সেবায়েত রেকর্ড করার আদেশ পাঠান সংশ্লিষ্ট আফিসারের কাছে ,তারিখ ২১ মার্চ ১৮৭২ সাল । কিন্তু কমিশনারের এই আদেশকে জগদম্বা ও অন্যান্য বাদিগণ পুনর্বিবেচনার জন্যে আবেদন জানালে কমিশনার সাহেব বিষয়টিকে ২৪ পরগণার কলেক্টরের নিকট ফেরত পাঠান আরও সাক্ষ্য প্রমাণের জন্যে তারিখ এপ্রিল ৪ ,১৮৭২ সাল কারণ জগদম্বার দাবী ছিলো পদ্মমনির সুযোগ দেওয়া সত্বেও তারা তাদের কর্তব্য গাফিলতি করে সময় নষ্ট করেছেন এবং সেবায়েত হিসাবে কাজ করতে অস্বীকার করেছেন । কমিশনের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে ১৮৭২ সালের ৪ মে তারিখে পদ্মমনি ‘কলিকাতা বোর্ড অফ রেভেন্যু’র কাছে আবেদন করেন , প্রার্থনা করেন যে কমিশনারের ১৮৭২ র ২১ মার্চ তারিখের আদেশকে পুনরায় বলবৎ করা হোক। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এবারেও তাদের আবেদন ১৮৭২ এর মে মাসেই নাকচ হয়ে যায় । তখন বাধ্য হয়েই পদ্মমনি ও অন্যান্যরা আইনের পথে উচ্চ ন্যায়ালয়ের দরজায় দাঁড়াতে বাধ্য হন । তার আগে পদ্মমনি তার এ্যটর্নি মারফত ট্রাষ্ট পরিচালনে তাদের সবার অংশীদারিত্ব প্রদানের দাবী জানিয়ে জগদম্বাকে পত্র দেন । তারপর ১৮৭২ সালে ২০শে জুন জগদম্বার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেন বিচারক ম্যাকফারসনের আদালতে । সেই সঙ্গে প্রয়োজনে রিসিভার বসানোর আবেদনও করেন । এটিই সেই বিখ্যাত
Suit No 308/1872
Puddomoney Dossee and ors. vs Jogodumba Dossee and ors .
In the High Court Judicatue at Fort William in Bengal
Ordinary orginal civil Judication
১৮৭৪ সালের ২১ ডিসেম্বরের রায়ে মিঃ ম্যাকফারসন দুই ভগ্নির ( পদ্মমনি ও জগদম্বার ) মধ্যে তৎকালে বিরাজিত তিক্ত বা সাপে নেউলে সম্পর্কের কথা যে ভাষায় ( সম্ভবতঃ বিরক্ত হয়ে বা মজা করে ) ব্যক্ত করেছেন তা ঐতিহাসিক নথি হিসাবে হুবহু নীচে তুলে দিলাম ভবিষ্যতে লোকমাতা রানি রাসমনি দেবীর দূরদর্শিতার সঠিক অনুধাবন করার জন্যে । These two persons are constantly and ceaselessly engaged in litigation of every description with each other and it is impossible for me to exclude from my ——- .’
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি প্রথমে বাদী, বিবাদী ছিলেন পদ্মমনি ভার্সেস জগদম্বা ,ওই দুজনের অবর্তমানে আসে বলরাম দাস ভার্সেস গুরুচরণ বিশ্বাস । রানি মাতার ইচ্ছাকে সম্মান জানালে ওই অপর্ণনামা অনুসারে রানি মাতার সকল তস্য নাতিগণ সকলে সমান অংশীদারিত্ব পান । এতো দীর্ঘদিন ধরে আইনের জটিল পথে হেঁটে হাইকোর্টের কড়িকাঠে প্রাণপাত করতে হয় না । রানি মাতার কৃপা ,মা কালীর আশীর্বাদ সকল তস্য নাতিগণের উপর সমানভাবে বর্ষিত হলে এই কাহিনীর উদ্ভবও হয় না । মাতার আশির্বাদ সমানভাবে বর্ষিত হয় নি বলে এই কাহিনীর উদ্ভব । কাগজের আদেশ কাগুজে মনে হয় । বাস্তবতা কোথায় ? এতোদিনে হুগলি নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে । বাদী ,বিবাদী এক হয়ে গেলেও মামলা নতুন জটিল রূপ ধারন করে । বর্তমানে এই মামলার বাদী ,বিবাদীর এক হয়ে গেছে তবুও মামলা নিষ্পত্তি হয় না ! মৃত বলরাম দাস ভার্সেস মৃত গুরুচরণ বিশ্বাস হাইকোর্টের চোখে এখনো জীবিত। এমন অন্ধ আইনের সাহায্যে মৃত বাদী ,বিবাদীকে স্যালাইন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা হচ্ছে এই মামলা । বাস্তবে ১৯২৯ সালের হাইকোর্টের আদেশের কোনো নির্দেশিকা মেনে চলা হয় না । এখন আইনি লড়াই যেমন জারি আছে থাকছে । হয়তো আগামী কোনোদিনে জানতে পারবো এর শেষ কোথায় এবং জানতে পারবো কারা কারা থাকবেন রানিমাতার সেবায়েত ।