পুবের কলম প্রতিবেদক : ভারতেও সেনার চাকরিতে শিখরা দাড়ি, পাগড়ি পরতে পারেন। সেটা নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের শ্রেণিকক্ষেও ‘হিজাব’ অনুমোদিত। এগুলিও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ভারতের স্কুলগুলিতে সরস্বতী বন্দনার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ সংবিধান, ধর্ম নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে হিজাবে বিধি-নিষেধ আরোপের এই রায় আসলে এক জগাখিচুড়ি আর মুসলিম মেয়েদের প্রগতির অন্তরায়। এ নিয়ে লিখেছেন গোলাম রাশিদ।
এই দেশের সর্বত্র ধর্মীয় চিহ্ন ছড়িয়ে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বট-অশ্বত্থের তলায় ছোট ছোট মন্দির। উড়ালপুলের সুবৃহৎ স্তম্ভে লেখা, ‘রাম নারায়ণ রাম’। লরির সামনে লেখা ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’। বাসে লেখা ‘জয় মা তারা’, ‘ওম’ চিহ্ন এঁকে দেওয়া হয়েছে সামনে। লেবু-লঙ্কা ঝুলছে গাড়ি, বাড়ি, দোকানের সামনে। এই দেশে ‘মানিকপীর বীজ ভাণ্ডার’, এর পাশেই ‘মা কালী মিট শপ’। এই দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু কোনও ধর্ম বা ধর্মীয় সংস্কৃতির বিরোধিতা করার রীতি নেই। প্রাচীন এই হিন্দুস্থান ধর্মীয় সহিষ্ণুতার পীঠস্থান হিসেবেই যুগ যুগ ধরে আর্য, শক, হুন, পাঠান, মুঘলদের আমল থেকে পরিচিত হয়ে আসছে। সেখানে কর্নাটক হাইকোর্ট (১৫ মার্চ, ২০২২) জানাল, যে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরে আসতে পারবে না। মাননীয় আদালত যে যুক্তিগুলি পেশ করেছে, তা অত্যন্ত দুর্বল এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের উপর কুঠারাঘাত। মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্ক থেকে ধর্মীয় চিহ্ন মুছে ফেলতে চেয়েছিলেন সফল হননি। মোদিজি অবশ্য ধর্মরাষ্ট্রে বিশ্বাস রাখেন। রামরাজ্যে বিশ্বাস রাখেন। বাবরির জায়গায় রাম মন্দির হয়ে গেল। রাষ্ট্র কিন্তু একফোঁটাও সেক্যুলার হয়নি গত দশ বছরে। বরং, ধর্মরাজ্যের আরও কাছাকাছি এসেছে। নারকেল ফাটানো, তিলক, সিঁদুর, ফুলচন্দন (সে রাফাল যুদ্ধবিমান হোক কিংবা ইসরোর রকেট)-এর ব্যবহার সমানে চলছে। এতে কেউ কোনওদিন আপত্তি করেনি । তাহলে সংবিধান ও ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে সংখ্যালঘুর অধিকারকেই শুধু খর্ব করা হচ্ছে নাকি? এটা এই সময়ের বড় প্রশ্ন। আর ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান, গণতন্ত্র, সংখ্যালঘু ও আইনজীবীদের অদ্ভুত সব যুক্তি সহকারে এ যেন জগাখিচুড়িও বটে।
ভারত এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যেখানে সেক্যুলার মানে ধর্ম পরিহার নয়, সব ধর্মকে সমান চোখে দেখা। খ্রিস্টান, ইহুদি, শিখরাও তাদের নিজেদের মতো পর্দাপ্রথা ও ধর্মীয় প্রথা মেনে চলে। তাদের ক্ষেত্রে এই হিজাবের রায় কি প্রয়োগ হবে? বিগত বছরগুলির ক্রনোলজির দিকে লক্ষ্য রাখলে দেখা যাবে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক, মন্দির, মসজিদ, দাড়ি রাখা, হিজাব-পরা কিংবা নামাযের জন্য জায়গা না-দেওয়া ইত্যাদি ইস্যু বারবার খাঁড়া করা হচ্ছে জনগণের সামনে। উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যেভাবে হিজাব ইস্যুটিকে তুলে ধরা হল, তা থেকে রাজনৈতিক অভীপ্সা স্পষ্ট। কর্নাটকের বিজেপি নেতারা পর্যন্ত বলেছেন, হিজাব নিয়ে যে, বিতর্কটি দেশে-বিদেশে ছড়ানো হল, তা উদুপীর ওই কলেজেই মিটিয়ে ফেলা যেত। সব ছেলেমেয়েরাই কোনও না কোনও ধর্মীয় চিহ্ন (তিলক, দাড়ি, পাগড়ি, সিঁদুর, শাঁখা, তাবিজ, মাদুলি, কবচ) সঙ্গে নিয়ে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে আসে। এই দেশের মানুষ ধার্মিক। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ধর্মীয় রীতিনীতি ও অনুশাসন মেনে চলতে স্বাছন্দ্য বোধ করেন (ব্যতিক্রমও আছে)। এরকম একটি দেশে হিজাব খুলে কলেজে আসলেই কি সেক্যুলারত্ব ‘প্রমাণ’ হয়ে যাবে! পূর্বসূরি ইয়েদুরাপ্পার যে, রাজনৈতিক কারিশ্মা ছিল, তার ধারেকাছেও নেই কর্নাটকের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বাসভরাজ বোমাই। তাই হার্ডলাইন হিন্দুত্বের পথ ধরে নিজের গদি মজবুত করতে চাইছেন তিনি, এমনই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।
এটা একটি রাজনৈতিক চাল হলেও সামাজিক প্রভাব পড়বে যথেষ্ট পরিমাণে। কর্নাটক হাইকোর্ট যে, রায় দিল, তা কিন্তু শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের পরিপ্রেক্ষিতে। মাননীয় বিচারপতিদের মতে, সংবিধানে মৌলিক অধিকারের উপর যে ‘রিজনেবল রেস্ট্রিকশন, এর কথা বলা হয়েছে তার অধীনে যে-কোনও প্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্ম রাখার অধিকার রয়েছে। সেক্ষেত্রে সেটা নাগরিকের অধিকার হরণ নয়। তাই স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম থাকলে সেটাই মেনে চলতে হবে। এই ইউনিফর্মের সঙ্গে মাথায় একখণ্ড কাপড় রাখার অনুমতি যদি হাইকোর্ট দিত, তবে তা সংবিধানের লঙ্ঘন হত না। বরঞ্চ সহিষ্ণু ভারতীয় সমাজের এক অনুপম চিত্র ফুটে উঠত। কিন্তু রাজনৈতিক রং লাগলে যা হয় আর কি! এভাবে আসলে মুসলিম মেয়েদের শিক্ষার রাস্তাটাকেই তারা পাথর দিয়ে আটকে ফেলছেন। এর ফলে অনেক রক্ষণশীল অভিভাবক যেমন তাদের মেয়েদের হিজাব ছাড়া (‘জয় শ্রী রাম’ বলে তেড়ে আসে যেসব ক্যাম্পাসে, সেখানে হিজাবি, বেহিজাবি সবাই অনিরাপদ) স্কুল-কলেজ পাঠাতে দ্বিধাবোধ করবেন, তেমনই নিজেদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ও সচেতন (কর্নাটকের ভাইরাল ভিডিয়োর সেই মুসকানের কথা নিশ্চয় মনে আছে) অনেকেই ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন না। আবার কর্নাটক থেকে অন্য রাজ্যও যদি ‘অনুপ্রেরণা’ পেয়ে হিজাবে নিষেধাজ্ঞা শুরু করে, তবে নরেন্দ্র মোদির ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ কিংবা ‘সবকা সাথ,সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’- এর বাণী মাঠে মারা যাবে।
কর্নাটক হাইকোর্টের বিচারপতিরা রায়দানে জানিয়েছেন, হিজাব পরিধান ইসলাম ধর্মের বাধ্যতামূলক অনুশীলন নয়। এই ধরনের সিদ্ধান্তে তাঁরা কীভাবে পৌঁছাতে পারেন? তাঁরা কি কোনও ইসলামী শরীয়ত বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন? তাঁদের যুক্তি হল, বহু মুসলিম মহিলাকেই হিজাব পরতে দেখা যায় না। তার মানে ইসলামে এটা বাধ্যতামূলক নয়। নামায, রোযাও তো বহু মানুষ পালন করে না। এগুলি কি বাধ্যতামূলক ধর্মীয় অনুশাসন নয়? কেউ পালন না করলেও সেটা ধর্মের অঙ্গ, এটা বুঝতে বিচারপতি হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ইসলামী আইনের প্রধান উৎস পবিত্র কুরআন। সেই কুরআনের সূরা আল আহযাবের ৫৯ নং আয়াতে স্পষ্ট বলা আছেক্ষ ‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিনদের নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে দেয়।’এই বাক্যটি হিজাব বা শালীন পোশাকবিধির অন্যতম উৎস। এটি বোধহয় নজর এড়িয়ে গিয়েছে। হিজাব ইসলামের অংশ নয় এটা প্রথমেই বলে দেওয়াতে সংবিধানের ২৫ নং ধারাতে ধর্মীয় স্বাধীনতার যে অধিকার রয়েছে, তার আর লঙ্ঘন হল না। খুব সুচতুরভাবে কাজটা করা হয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে!
আসলে আমরা যত আধুনিক হচ্ছি, তত যুক্তিবোধ ও ন্যায়বোধকে বিসর্জন দিচ্ছি। ধর্মীয় অনুশাসন ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতেই পারে। আদালতের কাছে সেটা বড় ব্যাপার নয় (যদিও বাবরির রায় দেওয়ার সময় মিথ বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল)। কিন্তু পিছিয়েপড়া সমাজের শিক্ষা ও সমান অধিকারের ব্যাপারটা দেখা আদালতের কর্তব্য। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ বজায় রেখে যেন জীবন-যাপন করতে পারে, সেই অধিকারও সংবিধান সুরক্ষিত করেছে। কিন্তু সবকিছুই লিখিত আকারে থেকে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে দিল্লির একজন মহিলা বলেছেন, আমাদের ক্রমাগত মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে, শিক্ষা গ্রহণ করতে হলে আমাদের অবশ্যই আমাদের ধর্ম ত্যাগ করতে হবে। এটা যে মহিলাদের ব্যক্তিগত পছন্দ, তা মানুষ মানতেই চায় না। যারা হিজাব বেছে নেয় তারা বলে যে, এটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় সিদ্ধান্ত নয়। বরং এটা তাদের ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন।
আর এ কথা মনে রাখতে হবে শুধু মুসলিমরা নয়, এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু মহিলারাও মাথা ঢেকে রাখেন। ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে মাথা ঢাকার ব্যাপারটি তুলনামূলকভাবে সাধারণ। ২০১৯-২০ সালে পরিচালিত পিউ রিসার্চ সেন্টারের সমীক্ষা অনুসারে ভারতে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন মহিলা (৬১ শতাংশ) বলেছেন, যে বাড়ির বাইরে তারা তাদের মাথা ঢেকে রাখেন। এর মধ্যে রয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু (৫৯ শতাংশ), মুসলিম (৮৯ শতাংশ) এবং শিখ মহিলারা (৮৬ শতাংশ)। আবার আমেরিকা, ব্রিটেন কানাডা, এই দেশগুলিও গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বিশ্বে বহুল পরিচিত। এই দেশগুলি-সহ অন্যান্য কয়েকটি দেশের ক্যাম্পাসে, শ্রেণিকক্ষে, সেনাবাহিনী এবং পুলিশের চাকরিতে হিজাবের অনুমতি রয়েছে। ভারতেও সেনার চাকরিতে শিখরা দাড়ি, পাগড়ি পরতে পারেন। সেটা নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা এবং নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের শ্রেণিকক্ষেও ‘হিজাব’ অনুমোদিত। এগুলিও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ। ভারতের স্কুলগুলিতে সরস্বতী বন্দনার উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। অথচ সংবিধান, ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে হিজাবে বিধি-নিষেধ আরোপের এই রায় আসলে এক জগাখিচুড়ি আর মুসলিম মেয়েদের প্রগতির অন্তরায়। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় মুসলিম মেয়েরা বলেছিল : ‘থাকব না কো বদ্ধ ঘরে, দেখব এবার জগৎটাকে।’ কিন্তু সেসব শুনছে কে!