রেজাউল করিম, মোথাবাড়িঃ সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে ভারতের মাটিতে পা দিলেন মালদার কালিয়াচকের পড়ুয়া নুর হাসান। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন । ট্রেনে মালদার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন তিনি। শুক্রবার ভোরে বাড়িতে আসছেন। তাঁর অপেক্ষার প্রহর গুনছেন পরিবারের সদস্যরা। ভারতের মাটি ছুঁতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস পরিবারের সদস্যদের মধ্যে।
ইউক্রেনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা ফোনে জানালেন নুর। নুর জানান, রোমানিয়ে বর্ডার হয়ে তিনি এসেছেন। কিন্তু ইউক্রেন পুলিশের দুর্ব্যবহার এবং বর্ডার পার হওয়ার ঘটনা আজীবন তাঁর স্মৃতি হয়ে থাকবে। ওই দিন বর্ডারে তখন প্রায় ৩ হাজার ভারতীয় অপেক্ষারত। এদিকে ইউক্রেনের পুলিশ ২০ মিটার পর পর ৫-৬ জন করে বর্ডার পার করছেন। কাউকে ৪ দিনও অপেক্ষা করতে হচ্ছে সেখানে। তাপমাত্রা ১০ হিমাঙ্কের নীচে। যে ক্যান্টিন রয়েছে সেখানে ভারতীয়দের খাবারের অনুমতি ছিল না। এমনকি শৌচাগারও নেই কোথাও। জলের সমস্যা। এদিকে চলছে পুলিশের অত্যাচার। একটু ভিড় হলেই মারধর শুরু করে দিচ্ছে তারা। এমনকী বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারধরও করে। শূন্যে গুলিও ছোঁড়ে। অভুক্ত থেকে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে কোনও মতে বর্ডার পেরিয়ে রোমানিয়াতে এসে পৌঁছন। রোমানিয়ায় পৌঁছনোর পর তাদের বেশ সাহায্য পাওয়া গেছে। যদিও প্রায় ৭ ঘন্টা অপেক্ষার পর বিমানঘাঁটিতে আসতে পারে। সেখানেও প্রায় ১৪-১৫ ঘন্টা অপেক্ষার পর ভারতে আসার বিমানে উঠতে পারেন। দিল্লিতে নেমে আবার বিমানে কলকাতা এসে পৌঁছন তিনি।
৩ বছর ধরে তিনি ইউক্রেনের ভিনিচিয়ায় রয়েছেন। ডাক্তারির ছাত্র তিনি। গত বছরের ১১ আগস্ট তিনি ইউক্রেনে যান। এখন পুরোদমে পড়াশোনা চলছিল। সামনে তাঁদের পরীক্ষা ছিল। আরও ৩ বছর থাকার কথা। বাবা হাসিদুর রহমান লরি ব্যবসায়ী। মা রোকেয়া বিবি গৃহবধূ।
৩ ভাই ও এক বোন। নুর হাসান মেজো ছেলে। বড় ছেলে যাদবপুরে ফার্মাসিস্ট পড়ছেন। আর এক ছেলে হাওড়াতে প্যাথোলোজি বিভাগে পাঠরত পড়ছেন।
কালিয়াচক থানার কালিয়াচক ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের নয়াবস্তি সাইফুদ্দিন সর্দারটোলা গ্রামের বাসিন্দা নুর হাসান।
বাবা হাসিদুর রহমান বলেন, ‘আমার ছেলে এই ভয়বহ পরিস্থিতিতে বাড়ি ফিরছে। ভারতের মাটি ছোঁয়ার পর স্বস্তি পেয়েছি। এখনও ছেলেকে দেখার অপেক্ষায় মুখিয়ে রয়েছি আমরা। আমার ছেলের মতো অন্য ভারতীয়রাও নিজ নিজ ঘরে নিরাপদে ফিরুক এই প্রার্থনা করছি সবসময়। ওখানে হাজার হাজার ছাত্র আটকে আছে। যুদ্ধ কী জিনিস জানলাম। এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।’ ইউক্রেন ফেরত ছেলে নুরের কথায়, ‘মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখলাম। বাঙ্কারের মধ্যে আমরা থাকলেও সবসময় বোমা-মিশাইলের শব্দ। এখনও যেন তাড়া করে বেরাচ্ছে। আমি প্রার্থনা করি যাতে ইউক্রেন নিরাপদে থাকুক। সকলে নিজ বাড়ি নিরাপদে ফিরুক আর আবার আগের মতো পরিস্থিতি ফিরে আসুক।’
নুরের মা রোকেয়া হাসানের কথায় একটু হলেও ছেলে বাড়ি আসছে জেনে স্বস্তি মিলেছে। নুরের মা বলেন, আমার ছেলেকে ডাক্তারি পড়াতে আমি ইউক্রেনে পাঠাই। আমার ছেলে ওখানে আড়াইবছর থেকে পড়াশোনা করছিল। মাঝখানে করোনার কারণে বাড়িতে ফিরে আসে। এসে তখন ছয়-মাস ছিল। তারপরেই পরিস্থিতি একটু ঠিক হতে আবার আমি বলি ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে এই যুদ্ধ লেগে গেছে ইউক্রেনে। আমার ছেলে আমাকে ফোন করে যুদ্ধ পরিস্থিতির কথা জানায়। এই অবস্থা শুনে বলি তাকে বাড়ি ফিরে আসতে। কিন্তু ছেলে জানায়, কলেজ থেকে বলেছে ক্লাস হবে। বলল যে অফলাইনে ক্লাস হবে। আমি তাও বলি, ওখানে থাকতে হবে না তুমি ফিরে এসো। তখন আমার ছেলে জানায়, ঠিক আছে ভাবনা চিন্তা করে দেখছি। কিন্তু এর পরেই রাতে হঠাৎ ফোন এখুনি বিমানের টিকিট করতে হবে। এর পর আমার ছেলে জানায় ২৭ তারিখে বিমানের টিকিট হয়ে গেছে। ২৪ তারিখে যারা বিমান ধরতে গিয়েছিল ওর বন্ধুরা সকলেই ফেঁসে যায়। এর পরে ছেলে জানায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, ফ্লাইটের টিকিট বাতিলও হয়ে গেছে। ছেলে জানায় মনে হয় আর বাড়ি ফিরতে পারব না।
এর পর ছেলের সঙ্গে অনবরত যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে থাকি। ছেলে জানায়, বাইরে সাইরেনের শব্দ শুনলেই বাঙ্কারে নেমে যাই। ছেলের কাছে জানতে চাই, কিছু বাজার আনাজ পাতি তার কাছে আছে কিনা? সে জানায় দু-তিনদিনের জন্য খাবার মজুদ ছিল। দোকান-বাজার সব বন্ধ।
ওই আবাসনের ৯’তলায় থাকত আমার ছেলে। কিন্তু ছেলে জানায় এখন আর ওপরে গিয়ে রান্নাও করতে পারছে না তারা।
এর পর আবার ছেলে জানায়, ইউক্রেন দূতাবাস তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। কলেজ থেকে পাঁচ থেকে ছয়টা বাসের ব্যবস্থা করা হয়। তার পর সেই বাসে করে রোমানিয়া বর্ডারে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু ছেলের কাছে জানতে পারি আরও প্রায় ৫ হাজার পড়ুয়া এখনও আটকে আছে। রোমানিয়া বর্ডারে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে অনেক কষ্ট করে আমার ছেলে রোমানিয়া সীমান্ত পার করে। ওখান থেকে বাসে করে বিমাবন্দরে আসে। দিল্লিতে পৌঁছে ছেলে আমাকে ফোন করে জানায় সে এসে গেছে। এর পর সেখান কলকাতা বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে সে সটান চলে যায় আমার বোনের বাড়ি যাদবপুরে। এখন সেখানে সে আছে। ছেলে পুরোপুরি বাড়ি না ফেরা পর্যন্ত শান্তি নেই।