দেবশ্রী মজুমদার, শান্তিনিকেতন: ক্ষুদে বাচ্চাকে সাথে নিয়ে সুদূর চব্বিশ পরগণার ডায়মণ্ডহারবার থানার কবিরা গ্রাম থেকে আসেন জুবেরা বেওয়া। স্বামী সেখ রহমতের মৃত্যুর পর ছেলে সেখ রিয়াজকে নিয়ে খুব কষ্ট করে মানুষ করছেন তিনি। তালপাতার টুপি বা টোকা তৈরী করেই তাঁর সংসার চলে। বোলপুর, পানাগড়, জয়দেব সর্বত্র তালপাতার টুপি বিক্রি করেন।
ডাকবাংলোর মাঠের মেলায় জুবেরা বেওয়া বলেন, শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলায় বরাবর এসেছি। দুবছর ধরে মেলা হয় না। এবারও হলো না।
তবুও ভালো ডাকবাংলো মাঠে মেলা হচ্ছে। তাই নিজের হাতে তৈরী তালপাতার টোকা নিয়ে আমি হাজির ।
আলাপচারিতায় জানালেন, খুব অভাবের সংসার। কবিরা গ্রামেই তালপাতা সংগ্রহ করেন। স্ত্রী তারপর নিজে তৈরী করেন তালপাতার টুপি। যাকে শান্তিনিকেতনে সবাই টোকা নামেই চেনে। তিনি বলেন, দৈনিক একজন ছটা টোকা বানাতে পারে। কাঁচা তালপাতা গাছ থেকে পেড়ে একদিন শুকোতে হয়। তারপর সুতো দিয়ে সেলাই করে টোকা বানানো হয়। তারপর রঙ করা হয়। এক একটি টোকার দাম চল্লিশ থেকে ষাট টাকা। গোটা দিনের আয় আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা। সংসার চলে না। মমতা দিদি সবার কথা ভাবে। আমার আবেদন তার কাছেই। তিনি গরীবের মা বাপ। যদি কিছু হয়।
তাঁরা মোট আটজন এসেছেন ডায়মণ্ডহারবার থেকেই। ভাড়া দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাই ফুটপাতে ব্যবসা। তিনি জানান, মেলায় দৈনিক তিনশো আয়। খোরাকি বাবদ ব্যয় দুশো টাকা। হাতে থাকে একশো। ছড়ির দেখা মিললো মেলাতেই। বিক্রেতা আমিনুল হোদা জানান, ছড়ি বিভিন্ন দামের। চল্লিশ থেকে ষাট।
ঐতিহ্য হারায় নি মেলা। তাই মেলায় আজও পাওয়া যায়, টোকা ও ছড়ি। যা ছিল শান্তিনিকেতনের মেলা ফেরত আসার একমাত্র নিশান। শান্তিনিকেতনের মেলার কৌলিন্য হল টোকা আর ছড়ি। যার হাতে ছড়ি আর মাথায় তালপাতার টোকা। তাকে দেখে বোঝা যেত সে শান্তিনিকেতনের মেলা থেকে এসেছে। আগে আসে পাশের গ্রামের লোকেরা এই টোকা আর ছড়ি বানিয়ে এই মেলায় বিক্রি করতে আসত। সেই তালপাতার টোকা সারা বছর ব্যবহার করত আশ্রমিক থেকে এলাকার অনেকেই। যে কোন গ্রীষ্মের দুপুরে শান্তিনিকেতনের খোয়াই পথ ধরে মাথায় এই টোকা নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেতে দেখা যায় অনেককেই। এর ব্যতিক্রম ঘটে নি নোবেল জয়ী অমর্ত্য সেন কিমবা প্রবীন আশ্রমিক সৌমেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রেও। সকলের মাথায় শোভা পায় এই টোকা। শান্তিনিকেতনের ব্যাগের সঙ্গে টোকা আর ছড়ি পৌষ মেলা তথা শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য। কোলকাতা থেকে আগত এক পর্যটক জানালেন, শান্তিনিকেতন মেলার বিশেষ ঐতিহ্য টোকা আর ছড়ি। এই মেলায় সেটা তা হাতে পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে ”। প্রবীন আশ্রমিক কালীপদ সিংহ রায় বলেন, “শান্তিনিকেতনের মেলার কৌলীন্যই তো টোকা ও ছড়ি। শান্তিনিকেতনে মেলা হলো না। তবে ভুবন ডাঙার কাছে এই মেলায় টোকা ও ছড়ি দেখে আনন্দ পেলাম”।