মুহাম্মদ মুস্তাক আলি, জঙ্গিপুরঃ সীমান্তে বিএসএফ -এর নজরদারি ১৫ কিমি থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিমি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিল পাস করা হয়েছে প্রথমে পাঞ্জাব এবং পরে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়। সীমান্তে ১৫ বনাম ৫০ কিমি পর্যন্ত বিএসএফ -এর এক্তিয়ার নিয়ে যখন বিতর্ক চলছে, ঠিক তখনই ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জোর উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমনকি সীমান্ত এলাকার পিচ রাস্তাগুলোও জরুরি ভিত্তিতে মেরামতি শুরু করার খবর পাওয়া গেছে। সোমবার সুতির মদনা মোড় থেকে চাঁদনি চক বিএসএফ ক্যাম্প পর্যন্ত পিচ রাস্তার সংস্কারের উদ্বোধন করেছেন সুতি বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস।
অন্যদিকে, সুতি-১ ব্লক এলাকাতে ইন্দো-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগের খবর পাওয়া গেছে। সূত্রের দাবি, এই ব্লকেরই নুরপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম নুরপুরের নারায়ণপুর ৮৫ নং মৌজার এবং নুরপুর ৮৬ নং মৌজার কৃষকদের জমি দেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। সূত্রের দাবি, এই দুই মৌজা মিলে যথাক্রমে ১৫৩ এবং ৩, সর্বমোট ১৫৬টি প্লট রয়েছে। দুই মৌজার মোট রায়তের সংখ্যা ১,৮০৫ জন।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গিয়েছে, সুতিতেই কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার জন্য ৪৪ একর কৃষি জমির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এই প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে সম্প্রতি সুতি-১ ব্লকে বিএসএফ আধিকারিক, সুতি-১ ব্লকের বিডিও এবং বিএল অ্যান্ড এলআরও এলাকার কৃষকদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসেন। কৃষকদের সঙ্গে বৈঠকের কথার সত্যতা মিলেছে বিডিও এইচ এম রিয়াজুল হকের কাছ থেকে। বিডিও জানিয়েছেন, কৃষকদের সঙ্গে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার প্রয়োজনে জমি দেওয়া হলে কেন্দ্র সরকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেবে। তাঁর দাবি, সুতি ব্লকের এই ১,৮০৫ জন রায়তের মধ্যে ৪১১ জন কৃষক জমি দেওয়ার জন্য ইতিমধ্যেই লিখিত সম্মতি জানিয়েছেন। বিডিও-র আরও দাবি, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের পরে আরও বহু চাষি জমি দেওয়ার মৌখিক আশ্বাস দিয়েছেন। অবশ্য সরকারি এহেন দাবির পরেও বেশিরভাগ কৃষকই জমি হস্তান্তরে ইচ্ছুক নয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে। অনেক কৃষকের বক্তব্য বহুফসলি এইসব জমি থেকেই সারা বছর তাদের অন্নের সংস্থান হয়। একবার জমি চলে গেলে ভবিষ্যতে তাদের অন্নের সংস্থানে অনিশ্চয়তা দেখা দিতে পারে বলে বেশিরভাগ কৃষক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
একইভাবে সুতি-১ ব্লকে জমি অধিগ্রহণের খবরে ফরাক্কা, সামশেরগঞ্জ, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা প্রভৃতি ব্লকের সীমান্ত এলাকার কৃষকদের মধ্যে জমি হারানোর আশঙ্কা দানা বেঁধে উঠছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ ২,২১৭ কিমি আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে। এই সীমানা সংলগ্ন এলাকাগুলো কোথাও আংশিক জলপথ হলেও বেশিরভাগই দুই-তিন ফসলি কৃষি জমিতে ভরা। মুর্শিদাবাদের আন্তর্জাতিক জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি গঙ্গা-পদ্মা প্রবাহিত হলেও নদীর দুই পাশে রয়েছে সবুজে ভরা ক্ষেত। সীমান্তে জমি অধিগ্রহণের খবরে সেই উদ্যোগের সমালোচনা উঠেছে বিভিন্নস্তর থেকে। এসডিপিআই -এর রাজ্য সভাপতি তায়েদুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিএসএফ -এর সীমান্ত নজরদারি ১৫ কিমি থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিমি করার বিরুদ্ধে সংগঠনের পক্ষ থেকে গণ-স্বাক্ষর করা হচ্ছে। কৃষি জমি অধিগ্রহণের উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করা হয়েছে এসডিপিআই-এর পক্ষ থেকে। তায়েদুল ইসলাম জানিয়েছেন, বিজেপি নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্র সরকারের ভ্রান্ত নীতির অন্যতম ফসল সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার উদ্যোগ। তাঁর মতে, এই কাঁটাতারের বেড়া সীমান্ত এলাকার ভারতীয় নাগরিকদের জীবনে বিপর্যয় এনেছে। তাহেদুল ইসলামের দাবি, হাজার হাজার কৃষক এই কাঁটা তারের বেড়ার কারণে তাদের জমিতে চাষ করতে নানাবিধ সমস্যার মাঝে পড়ছেন। বিএসএফ -এর হাতে অত্যাচারিত হচ্ছেন কৃষকরা। তায়েদুল ইসলামের আগাম হুঁশিয়ারি, কৃষি জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে শীঘ্রই গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।
কৃষি জমি অধিগ্রহণের সমালোচনা করেছেন জঙ্গিপুর কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নবকুমার ঘোষও। তাঁর বক্তব্য উন্নয়নের নামে কৃষি ব্যবস্থাকে কৌশলে ধ্বংস করতে চাইছে কেন্দ্র সরকার। নবকুমার ঘোষের দাবি, এমনিতে রাজ্যে কৃষি জমি অপর্যাপ্ত। এইভাবে কৃষি জমি অধিগ্রহণ হতে থাকলে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা বাড়বে। বিশিষ্ট কৃষক নেতা মুজফফর হোসেনের বক্তব্য, সরকারের এখন লক্ষ্য হয়েছে কৃষকদের ভাতে মারা। তিনিও কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানিয়েছেন। অবশ্য রাজ্য তৃণমূল সহ-সভাপতি মুহাম্মদ সোহরাবের মতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে কৃষকদের কাছে জমি অধিগ্রহণ করতে পারে দেশের সরকার।