জানেন কি একটা আস্ত উপন্যাস লেখা হয়েছে স্মার্ট ফোনে।
তাঁর এই ধারাবাহিক লেখা এমনই জনপ্রিয় হয় যে– তা পরে উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হওয়ার পরই সাড়া ফেলে দেয় ইসমাইল দরবেশের উপন্যাস ‘তালাশনামা।
ডোমজুড়ের দর্জিপরিবারে এই প্রতিশ্রুতিমান লেখকের জন্ম। তালাশনামার ইংরেজি অনুবাদ করছে হার্পারকলিন্স। যা প্রকাশিত হবে ২০২৩ সালে।
পুবের কলমে তাঁর সঙ্গে খোলামেলা আলাপচারিতায় সাংবাদিক সৈয়দ আলি মাসুদ
রইল ইউটিউব লিঙ্ক https://youtu.be/X-K2XHHJ5ag
তালাশনামা এর লেখকের সাক্ষাৎকার দেখতে চোখ রাখুন পুবের কলম সংবাদপত্র, ইউটিউব চ্যানেল এবং পুবের কলম ডিজিটালে
তথাকথিত লেখক কিংবা সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর পথ চলা শুরু হয়নি। হাওড়ার দর্জি পরিবারের মানুষ। আব্বা ওস্তাগর। পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে রয়েছেন এখনও। সেটাই তাঁর রুজিরুটি। তবে সমাজের নানা বিষয়– তাঁকে গভীরভাবে ভাবায়। মোবাইলে লিখতে শুরু করেন তিনি। পোস্ট করেন ফেসবুকে। একটি আস্ত উপন্যাস যে স্মার্টফোনে লিখে ফেলবেন— তা ভাবেননি কখনও। তাঁর এই ধারাবাহিক লেখা এমনই জনপ্রিয় হয় যে– তা পরে উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হওয়ার পরই সাড়া ফেলে দেয় দরবেশের উপন্যাস ‘তালাশনামা।’ বর্তমানে এই উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ করছে হার্পারকলিন্স। ‘পুবের কলম’ পত্রিকাকে খোলামেলা সাক্ষাৎকার দিলেন উপন্যাসিক ইসমাইল দরবেশ। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সৈয়দ আলি মাসুদ
পুবের কলম ¬ আপনার উপন্যাসের নাম ‘তালাশনামা’ কেন– কীসের অন্বেষণ? কীসের খোঁজ?
ইসমাইল দরবেশ ¬ আলো যদি স্বচ্ছ না হয়– তাহলে তা বিপজ্জনক। অস্বচ্ছ আলোতে বিভ্রান্তি বাড়ে। ধোঁয়াশা তৈরি হয়। চারিদিকে ধর্ম নিয়ে নানা আলোচনা। বিশেষ করে ইসলাম নিয়ে। কিন্তু তা ঐক্য তৈরি না করে কোথায় যেন বিভাজন বাড়াচ্ছে। অথচ এর থেকে পরিত্রাণ কী– তাও বুঝে উঠতে পারছি না। সেই কারণে জারি রয়েছে আমার তালাশ। তাই এই উপন্যাসের নাম তালাশনামা।
পুবের কলম ¬ আপনার নাম কি বরাবরই ইসমাইল দরবেশ– নাকি এই নাম আপনি নিয়েছেন?
ইসমাইল দরবেশ ¬ আমার নাম মুহাম্মদ ইসমাইল। আমার বন্ধু– পরিজনেরা আমাকে সেই নামেই চিনেন। দরবেশ আমার পছন্দের নাম। আমি সুফিবাদের ভক্ত। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে খানিকটা ভাবুক হওয়ার কারণে বাড়ির লোকজন কেউ কেউ আমাকে দরবেশ বলে ডাকতেন। তবে সেটা বাড়িতেই।
পুবের কলম ¬ আপনি হাওড়ার ডোমজুড়ের মানুষ– বড় হয়েছেন দর্জি পরিবারে। হাওড়ার ওই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংকট দেখে– উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়ও কি তাই?
ইসমাইল দরবেশ ¬ না। এখানে দর্জিপাড়াকে সামনে রেখে– তাদের সামাজিক ও অর্থনেতিক সংকটকে সামনে রেখে আসলে একটা বৃহত্তর জীবনের চালচিত্র আঁকা হয়েছে। সেখানে মসজিদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে– তেমনই ইসলাম অনুসারীদের বিভিন্ন মতভেদও রয়েছে। যা সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। কেবল মুসলিম সমাজজীবন নয়– স্বাভাবিকভাবেই হিন্দু সমাজের ছবিও সংযুক্ত হয়েছে। মুসলিমরা দেশের সংখ্যালঘু। কিন্তু এই উপন্যাসে আমি একটি মসুলিম-অধ্যুষিত গ্রামের সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের সংকট দিয়ে সংখ্যালঘুদের সমস্যাকে তুলে ধরেছি।
পুবের কলম ¬ আপনার আব্বা-আম্মা দু’জনেই কি হায়াতে আছেন? পারবিবারিকভাবে আপনি কি সাহিত্য করার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন– নাকি তা আপনার একান্ত নিজস্ব তাগিদ?
ইসমাইল দরবেশ হ্যাঁ– আল্লাহ রহমতে দু’জনেই হায়াতে রয়েছেন। সেই অর্থে আমি সৌভাগ্যবান। নীতিনৈতিকতা– মূল্যবোধের শিক্ষা তাদের হাত ধরেই পেয়েছি। আমার বাড়িতে বইপত্র প্রচুর রয়েছে। বাড়ির সকলেই কমবেশি লেখাপড়া করেন। আমার মা পড়তে ভীষণ ভালোবাসেন। বড়দাও পড়াশুনা ভীষণ ভালোবাসেন। বাড়িতে একটা ধর্মীয় পরিমণ্ডল রয়েছে। আব্বা-আম্মা দু’জনেই নামাযী। দাদাও তাই। বাড়িতে এত বই দেখে বড় হয়েছি যে– সাহিত্যের প্রতি একটা টান ভিতরে তৈরি হয়েছে সেই কৈশোর থেকেই।
পুবের কলম ¬ আপনি কি সাংবাদিকতাও করেছেন?
ইসমাইল দরবেশ ‘কলম’ পত্রিকার সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক। তখন ‘কলম’ সাপ্তাহিক ছিল। সেই সময় আমি এই পত্রিকায় লিখেছি। আমার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি এই ‘কলম’ পত্রিকা থেকে। এই পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বহু বছরের। তিনিই এক সময় আমাকে লেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আমি পেশার সুবাদে অসম– ত্রিপুরাতে যেতাম– সেখান থেকে সংবাদ পাঠাতাম। তা প্রকাশিত হয়েছে ‘সাপ্তাহিক কলম’-এ। হাওড়ার বহু খবর একসময় আমি করেছি।
পুবের কলম ¬ আপনার তালাশনামা ছেপেছে ‘অভিযান’– কীভাবে যোগাযোগ হল– যদি বলেন?
ইসমাইল দরবেশ আস্ত একটা উপন্যাস লেখার ভাবনা আমার মাথায় ছিল না। আমি মোবাইলে লিখতে শুরু করেছিলাম। ফেসবুকে তা পোস্ট করতাম। লেখা এমন জায়গায় শেষ করতাম যে– পাঠক বারবার অনুরোধ করত পরের কিস্তি লেখার জন্য। এইভাবে গোটা উপন্যাস আমি মোবাইলে লিখে ফেলি। পরে সৌমিত্র দস্তিদার আমাকে অভিযান পাবলিকেশনের মারুফ হোসেনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। তাঁরাই আমার প্রথম উপন্যাস তালাশনামা ছাপে ।
পুবের কলম ¬ হার্পারকলিন্সের মতো বিশ্বখ্যাত প্রকাশনীর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হল কেমন করে?
ইসমাইল দরবেশ একটি পোর্টালে সৌমিত্রদা আমার তালাশনামা প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। সেটাই নজরে আসে মি. রামাস্বামীর। এর পর আমার সঙ্গে এবং প্রকাশক অভিযান পাবলিশার্সের কর্ণধার মারুফ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন অনুবাদক মি. রামাস্বামী। এর দু’দিন পরে হার্পারকলিন্স -এর এডিটর রাহুল সোনিকে ‘তালাশনামা’র কথা জানানো হয়। রাহুল সোনি বইটির স্যাম্পেল ট্রানস্লেশন পাঠাতে বলেন। মিটিং-এ ‘তালাশনামা’-এর অনুবাদের প্রস্তাব পেশ করেন রাহুল সোনি। অনুবাদের প্রস্তাব পাশ হয়। স্থির হয় অফিসিয়াল কাগজপত্র এবং অনুবাদের কাজ সম্পন্ন করে ২০২৩ সালের গোড়ার দিকে ইংরেজি ভাষায় বিশ্বময় পাঠক দরবারে পৌঁছে যাবে ‘তালাশনামা’।
পুবের কলম ¬ সাধারণত উপন্যাসিকরা তাঁর উপন্যাসে সমাজকে একটা বার্তা দিতে চান– আপনি উপসংহারে ঠিক কি বলতে চেয়েছেন?
ইসমাইল দরবেশ আমি উপসংহারের আলাদা করে কোনও বার্তা দিইনি। আমি প্রথম থেকে নিম্নবিত্ত বাঙালি মুসলিম সমাজ ও সেখানকার ‘সংখ্যালঘু’ হিন্দু সমাজের একটা ছবি এঁকেছি। দুই সমাজের সম্পর্ক তুলে ধরেছি। ইসলাম নিয়ে পীরপন্থী– তাবলিগ জামাত ও আহলে হাদিসদের যে ভিন্ন বিচারবোধ– তীব্র মতপার্থক্য— তা তুলে ধরেছি। সার্বিক ঐকমত্যের আকাঙ্খা করেছি মনে মনে। কেবল খুঁজে ফেরেছি কী করে বিভেদ ও বিভাজনের বেড়াজাল থেকে মুক্তি মিলবে। সেই কারণেই আলাদা উপসংহার দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। তাই আমার উপন্যাসের নাম ‘তালাশনামা।’
পুবের কলম ¬ আপনি হজ করেছেন– হজের একান্ত অনুভূতি যদি শেয়ার করেন…
ইসমাইল দরবেশ হজ এমন একটা স্বর্গীয় অনুভূতি— যার শাধিক রুপ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে একটা কথা বলতে পারি– হজ করতে গিয়ে আমার মনে প্রথম এই তালাশ নামার অঙ্কুর তৈরি হয়েছিল। সেই অর্থে আমার এই হজের সঙ্গে ‘তালাশনামা’-এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমি ২০১৭ সালে হজে যাই। হজ করতে গিয়ে বন্ধু মারুফের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মূলত তালাশনামা নামার বীজ বপন হয়।
পুবের কলম ¬ কেবলই কি তালাশ? বলার মতো কি কিছুই নেই?
ইসমাইল দরবেশ আসলে আমরা আমাদের সভ্যতা– কৃষ্টি– সংস্কৃতি অন্যদের কাছে তুলে ধরতে পারিনি। সেটা আমাদের দুর্বলতা। তারা আমাদের অনেক কিছু হয়তো জেনেছে– আবার বহু সময় তা জেনেছে ভুলভাবে। যা তারা জেনেছে— তা তথ্যগতভাবে ভুল। এই ভুল ও অসত্য সাম্প্রদায়িক প্রীতির ক্ষেত্রে বহু সময় নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছে।
পুবের কলম ¬ এই কাজটি অবশ্য পুবের কলম পত্রিকা নিরলসভাবে করে চলেছে– প্রতিদিন পারস্পরিক অপরিচির দেওয়ালটা ভাঙতে চেষ্টা করছে…
ইসমাইল দরবেশ আসলে এটা খুব জরুরি। পরস্পরকে না জানার থেকেও মারাত্মক পরস্পরকে ভুল জানা। সেটা সম্পর্কের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। স্বাভাবিক সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়।
পুবের কলম ¬ এবার একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন– বিয়ে করেছেন?
ইসমাইল দরবেশ বিয়ে করেছি। আমার তিন সন্তান। দুই মেয়ে এক ছেলে। স্কুল-পড়ুয়া। নেহাতই শিশু।
পুবের কলম ¬ ওরাও আপনার মত সাহিত্যের জগতে পা রাখুক– সেটাই কি চান?
ইসমাইল দরবেশ প্রত্যেক বাবা-মা সন্তানের ভিতর দিয়ে নিজেদের মেলে ধরতে চায়। স্বাভাবিকভাবেই আমারও তেমন ইচ্ছা রয়েছে। কিন্তু সেটা নেহাতই ইচ্ছা। তাদের ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া নয়। তারা চাইলে সাহিত্যের অঙ্গনে আসতে পারে। চাইলে অন্য কিছুকে ভালোবেসে এগিয়ে যেতে পারে।
পুবের কলম ¬ এখন কি লিখছেন? উপন্যাস– নাকি ছোট গল্প?
ইসমাইল দরবেশ আমি আরও একটি উপন্যাস লিখছি। তার কাজ নব্বই ভাগ শেষ। উপন্যাসের নাম ‘রাঁঢ়ী দীঘির বৃত্তান্ত’। ওয়াহাবি ও ফরাজী আন্দোলনের সময়কালকে ধরার চেষ্টা করেছি। কিন্তু এটি ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস নয়। কেবল প্রসঙ্গক্রমে কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র এসে পড়েছে মাত্র। আসলে তালাশনামা লিখতে গিয়েই আমি দেখলাম– মুসলিমদের মধ্যে এই নেই-সেই নেই ভাবটা আজকের নয়। আজ থেকে ২০০ বছর আগেও এমনটা ছিল। তখনও নানা সামাজিক ও সাংস্টৃñতিক সংকট ছিল। ধর্মকেন্দ্রিক সমাজজীবনের জটিলতা ছিল। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার কথা ছিল সামনে বইমেলায়। তবে এই বইমেলায় তা আসছে না।