পুবের কলম ওয়েবডেস্ক: আসফাকউল্লা খান (২২ অক্টোবর ১৯০০ – ১৯ ডিসেম্বর ১৯২৭) ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একজন বীর যোদ্ধা। যিনি রামপ্রসাদ বিসমিলের সাথে শহীদ হয়েছিলেন। তাদের উভয়কে একই দিনে আলাদা জেলে ফাঁসি দেওয়া হয়।
শহীদ আসফাকউল্লা খান ১৯০০ সালের ২২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন উত্তর প্রদেশের শাহজাহানপুরে। তার পিতা, শফিক উল্লা খান পাঠান পরিবারের মানুষ ছিলেন। তার মা মাজহুর-উন-নিসা ছিলেন একজন ধার্মিক নারী। আশফাকউল্লা ছিলেন চার ভায়ের ভেতরে সবচেয়ে ছোট ছেলে। তার বড় ভাই রিয়াসাত উল্লাহ খান ছিলেন পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিসমিলের সহপাঠী। যখন মইনপুর ষড়যন্ত্রে বিসমিলকে অভিযুক্ত করা হয়, রিয়াসাত তার ছোট ভাই আশফাককে বিসমিলের উর্দু শায়ের কবিতার শক্তি ও সাহস সম্পর্কে বলেছিলেন। তারপর থেকেই আশফাক বিসমিলের সাথে তার কবিতার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য সাক্ষাতে আগ্রহী ছিলেন।
সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই ১৯১৮ সালের মৈনপুরী ষড়যন্ত্র মামলার পরে আসফাকউল্লা খান গভীরভাবে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেবার জন্য অনুপ্রাণিত হন। ইতিমধ্যে বাংলার বিপ্লবীদের মধ্যে কানাইলাল দত্ত এবং ক্ষুদিরাম বসুর আত্মবলিদানের কথা তিনি শুনেছিলেন, যা তাঁকে আরো বেশি প্রভাবিত করে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন ইংরেজিতে ওয়াল্টার স্কটের কবিতা ‘লাভ ফর কান্ট্রি’ পড়ে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্কুলের শিক্ষক তাঁকে ‘প্যাট্রিয়টস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি বই দিয়েছিলেন। যা পড়ে তাঁর অনুভূতি হয়, যে দেশের জন্য যারা প্রাণ দেয় তারাই একমাত্র অমরত্ব লাভ করেন।
১৯২২ সালে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, রামপ্রসাদ বিসমিল জনগণকে আন্দোলন সম্পর্কে বলার জন্য শাহজাহানপুরে সভা সংগঠিত করেন। আশফাক তার সাথে জনসভায় সাক্ষাৎ করেন এবং নিজেকে তার সহপাঠীর ছোটভাই হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বিসমিলকে আরো বলেন যে, তিনি ‘ওয়ার্সি’ এবং ‘হযরত’ ছদ্মনামে কবিতা লেখেন। বিসমিল ব্যক্তিগত যোগাযোগ করে শাহজাহানপুরে তার কিছু কবিতার চরণ শোনেন এবং তারা ভালো বন্ধুতে পরিণত হন। আশফাক মাঝেমাঝেই কিছু লিখতেন এবং তা বিসমিলকে দেখাতেন, বিসমিল তা সংশোধন ও উন্নতি সাধন করতেন। এভাবেই দুই কবির এক উন্নতি ঘটে এবং এটি এতোই পরিচিতি পায় যে যারাই তাদের কবিতা কোনো কনফারেন্সে শুনতেন, তারাই উর্দু ভাষায় তাদের মুশায়েরা শুনে বিস্মিত হতেন।
ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের সাহস দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। ভাইসরয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডকে নিয়োগ করে মামলাটি তদন্ত করবার জন্যে। এক মাসের মধ্যে প্রায় সব বিপ্লবীদের একরাতেই গ্রেফতার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২৫ সালে সকালবেলা পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিসমিল এবং অন্যান্য বিপ্লবীদের পুলিস গ্রেফতার করে। কিন্তু আসফাক ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যার খোঁজ পুলিস পায় নি। আসফাক লুকিয়ে পড়েন এবং বারাণসী যাত্রা করেন, সেখান থেকে বিহার গমন করেন এবং সেখানে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিতে দশ মাস কাজ করেন। তিনি বিদেশ যেতে চেয়েছিলেন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে মূর্ত সহায়তার জন্য লালা হর দয়ালের সাথে সাক্ষাৎ করতে চেয়েছিলেন। তিনি কীভাবে দেশ ত্যাগ করবেন তা বের করতে দিল্লি যান। সেখানে তিনি তার একজন পাঠান বন্ধুর সহায়তা নেন এবং সেই বন্ধুটিই বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিসকে জানিয়ে দেয় এবং আসফাককে পুলিস গ্রেফতার করে।
তৎকালীন পুলিস সুপার তাসাদ্দুক হোসেন, বিসমিল এবং আসফাকের মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভূমিকা দেখাতে চেষ্টা করে। সে “বিসমিলের” বিরুদ্ধে আসফাককে উত্তেজিত করতে চেষ্টা করে। কিন্তু আসফাক ছিলেন দৃঢ়চেতা ভারতীয়, যিনি এসপি তাসাদ্দুক হোসেনকে এই বলে বিস্মিত করেন, “আমি পণ্ডিত রাম প্রসাদকে আপনার চেয়ে ভাল জানি, আপনি যেমন বলেছেন তিনি এমন ব্যক্তি নন। কিন্তু এমনকি আপনি সঠিক হলেও আমি নিশ্চিত যে একজন হিন্দু হিসেবে, তিনি ব্রিটিশ ভারতের চেয়ে অনেক ভাল হবেন, যাদের কাছে আপনি চাকরের মতো সেবা করছেন।”
আসফাকউল্লা খানকে ফৈজাবাদ জেলে প্রেরণ করা হয়। তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রুজু করা হয়। তার ভাই রিয়াসাত উল্লা খান কৃপা শঙ্কর হাজেলা নামে একজন সিনিয়র উকিল নিয়োগ করেন। মি. হাজেলা শেষ পর্যন্ত মামলাটি পরিচালনা করেন কিন্তু তার জীবন বাঁচাতে ব্যর্থ হন।
জেলে থাকাকালীন, আসফাকউল্লাহ খান প্রতিদিন কুরআন তেলাওয়াত করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন। কাকোরী মামলায় চারজন সাহসীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে শেষ হয়। তারা হলেন, পণ্ডিত রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা খান, রাজেন্দ্র লাহিড়ী এবং ঠাকুর রোশন সিং। বাকি ১৬ জনের বিভিন্ন মেয়াদে চার বছর থেকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।
জানা যায়, ফাঁসির চারদিন আগে, দুজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা যেখানে আসফাক থাকতেন সেই নিঃসঙ্গ সেল দেখতে আসেন। তিনি তখন নামাজের মধ্যে ছিলেন। একজন কর্মকর্তা বিড়বিড় করে বলল যে “আমি দেখতে চাই যখন এই ইঁদুরটিকে ঝোলানো হবে তখন তাঁর কতটুকু বিশ্বাস থাকে”। কিন্তু আসফাক তার নামাজ নিয়মমাফিক চালিয়ে গেলেন এবং দুজনই বাতাসের মতো মর্মর শব্দ করতে করতে বেরিয়ে গেল।
১৯ ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে আসফাকউল্লা খানকে দুইস্তর বিশিষ্ট উপরে বেদিতে নেওয়া হয়। তাকে শিকল থেকে মুক্ত করা হয়, তিনি ফাঁসির দড়ির কাছে যান এবং সেটিকে চুমু খেয়ে বলেন, “আমার হাত কোনো মানুষ হত্যা করেনি। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বানোয়াট। আল্লাহ্ আমাকে ন্যায়বিচার দেবেন।” অবশেষে তিনি মাত্র ২৭ বছর বয়সে শাহাদাত বরণ করেন।
উল্লেখ্য, আশফাক ছিলেন একজন নিষ্ঠ মুসলিম এবং দেশের প্রতি তার স্নেহ ছিল অতুলনীয়। হিন্দি কবি অগ্নিবেশ শুক্লা “আশফাক কী আখিরি রাত” নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। যেটাতে তিনি ভারতের এই মহান সন্তানের আবেগকে প্রকৃত অর্থেই ফুটিয়ে তুলেছেন।
আরও খবর পড়ুনঃ
- পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে ১৪ হাজীর মৃত্যু, নিখোঁজ ১৭ জন
- কোটায় ফের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার্থীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার
- সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে পুনরায় নিট পরীক্ষা, জানালেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান
- আটকে পড়া পর্যটকদের সাহায্য করতে সিকিমে হেল্পডেস্ক চালু নবান্নের, দেওয়া হল হেল্পলাইন নম্বর
- অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন অভিষেক