দেবশ্রী মজুমদার, বোলপুর: নাম প্রীতিকণা জানা। বছর পাঁচেক আগে, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেঁজুরি গ্রাম থেকে সুদূর বীরভূমের শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন আইন নিয়ে পড়তে। কলেজ যাওয়া আসার পথে তাঁর চোখ যায় কলেজ সংলগ্ন আদিবাসী পাড়ার শিশুদের দিকে। সেই থেকেই চলছে নিয়মিত পাঠ দান, আর সেদিনের সেই আইনের ছাত্রী আজ হয়ে উঠেছেন কালিদাস বাসকি, রেখা মুর্মুদের আদরের দিদিমণি।
আদিবাসীদেরকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে পাঠশালা খুললেন আইনের ছাত্রী। বীরভূম জেলায় আইন নিয়ে পড়তে এসে স্নাতক হয়েও পা দিলেন না আদালতের চৌকাঠে। বরং আদিবাসী সমাজের নতুন প্রজন্মকে ‘সু-শিক্ষা’ দিয়ে তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞায় থেকে গেলেন বীরভূমে।
জেলার গোপালনগর আদিবাসী গ্রামে মোড়ল বাড়ির উঠোনেই শুরু করেছেন নিজের পাঠশালা। তিনি দেখেন তাদের বাবা মায়েরা সংসার চালানোর তাগিদ কাজে চলে যাচ্ছেন। আর তাদের বাচ্চারা যথারীতি ঘরেই থাকছে, আবার কেউ হয়তো স্কুলে যাচ্ছে তবে তা নিয়মিত নয়। এই সব দৃশ্যই কার্যত ভাবিয়ে তুলেছিল তাকে। সেই ভাবনা থেকেই তিনি শুরু করেন তাদেরকে শিক্ষাদান।
প্রথমে তাঁদেরকে একজোট করার চেষ্টা করেন, এবং গ্রামের একটি অঙ্গনওয়ারী কেন্দ্রে শুরু হয় তাঁর পাঠশালা। কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে সেখানে ছাত্রছাত্রীরার সংখ্যা বাড়তে শুরু করলে পাঠশালা শুরু হয় গ্রামের ক্লাব ঘরে। সেখানেও পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অবশেষে নিজের বাড়ির উঠোনই ছেড়ে দেন গ্রামের মোড়ল চুরকু বেসরা। বর্তমানে সেখানেই চলছে নির্বিঘ্নে পাঠদান।
তবে সেখানে যে শুধু পুঁথিগত শিক্ষায় দেওয়া হয় এমন নয়। বই পড়ার পাশাপাশি প্রীতিকণা দেবী তাঁর ছাত্র ছাত্রীদেরকে জীবন বোধ, সমাজ বোধের পাঠও দিয়ে যাচ্ছেন রীতিমতো। ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীদের জন্য খাতা, বই থেকে শুরু করে যাবতীয় সমস্ত পড়াশুনার সরঞ্জাম হোক বা তাদের খেলাধুলোর সরঞ্জাম সমস্ত কিছুর যোগানও তিনি নিজেই নিজের হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে জোগাড় করেন।
পাঠশালার এক ক্ষুদে ছাত্র দেব বাসকি জানায়, “দিদিমণি আমাদেরকে মজা করে পড়ায়। আমাদের সঙ্গে খেলা করে, ছবি আঁকায়। তাই এখন আর এদিক ওদিক আর ঘুরে বেড়ায় না।”
প্রীতিকণা দেবীর জানান, তিনি যে সময় এখানে পড়াশোনার জন্য আসতেন তখন তিনি দেখেছিলেন এই শিশুরা এক রকম স্কুল ছুট। বাড়িতে বাবা মা না থাকায় তাদেরকে শাসন করার কেউ নেই, যার ফলে তারা এক রকম বাউন্ডুলে জীবন যাপন করতো। এটাই তাদের সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। তাই তিনি তাদেরকে সেই শাসনটুকু দিয়ে তাদেরকে পড়াশুনা করিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখেছেন।
গোপালনগর একটি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা, এবং সেই গ্রামের প্রতিটা মানুষই পুঁথিগত ভাবে অশিক্ষিত। তাই তাদের মনে একটা ধারণা জন্মেছিল
শহরের মানুষরা তাদের বাচ্চাদেরকে ভুলিয়ে হয়তো বাইরে বিক্রি করে দেবে। যার জন্যে এই আদিবাসীরা বহুদিন তাদের বাচ্চাকে এখানে পাঠাতো না, তবে ধীরে ধীরে গ্রামের মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছেন তিনি। এখন প্রীতিকনা দেবীর পাঠশালায় এখন প্রায় চল্লিশজন বাচ্চা আসে পড়তে।
গ্রামের মোড়ল চুড়কু বেসরা স্বীকার করেন যে প্রথম প্রথম তারা একটু ভুল বুঝেছিলেন দিদিমণিকে এখন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন দিদিমণি আসলে তাঁদের ভালোই করবে। তাই যখন জায়গার অভাবে বাচ্চাদের পড়াশুনার সমস্যা হচ্ছিল, তখন তিনি নির্দ্বিধায় তাঁর বাড়ির খোলা উঠোন ছেড়ে দেন দিদিমনিকে। এখন তাঁর বাড়ির উঠোনে একদল ছেলে মেয়ে পড়াশুনা করে, খেলা করে দেখতে বেশ ভালো লাগে। আনন্দও হয়।
প্রীতিকণা দেবী জানান যে, এই সমস্ত বাচ্চার পড়াশোনার যাবতীয় খরচা এখন তিনিই বহন করেন, আগামীতেও করবেন। এই বাচ্চারা যতদূর পড়াশুনা করতে চায় তিনি করাবেন।
আরও খবর পড়ুনঃ
- পবিত্র হজ পালনে সৌদি আরবে ১৪ হাজীর মৃত্যু, নিখোঁজ ১৭ জন
- কোটায় ফের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার্থীর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার
- সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে পুনরায় নিট পরীক্ষা, জানালেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান
- আটকে পড়া পর্যটকদের সাহায্য করতে সিকিমে হেল্পডেস্ক চালু নবান্নের, দেওয়া হল হেল্পলাইন নম্বর
- অস্ত্রোপচার শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেন অভিষেক