মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে মানবিক মূল্যবোধের নিরন্তর চর্চা হওয়া জরুরি। একটি সুস্থ সুন্দর প্রগতিশীল সমাজের জন্য আমাদের সবাইকে নৈতিক অধঃপতন ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। ১০ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে এই বিষয়ে লিখেছেন বিশিষ্ট স্নায়ু-মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (হোমিওপ্যাথি) ডা. জাকির হোসেন লস্কর বর্তমান শতাব্দীতে আমরা অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে প্রবল মানসিক চাপে বিপর্যস্ত। ঘরে ঘরে আজ মনোবিকার ও মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার পরিসংখ্যান বলছে– বর্তমান বিশ্বে প্রতি ৩-৪ জন মানুষের মধ্যে ১ জন মানসিক সমস্যার শিকার। সারা পৃথিবীতে ৫৮ কোটিরও বেশি নারী-পুরুষ এই সমস্যায় ভুগছে। করোনা আবহে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ মেন্টাল হেলথ এ বছর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্যদিবসের (১০ অক্টোবর) শ্লোগান রেখেছে Mental health in an unequal world যার অর্থ হল অসাম্যের পৃথিবীতে মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা। আধুনিক যুগে সমাজ-জীবনের বিবিধ ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণে ভেঙে যাচ্ছে সুস্থ পারিবারিক সম্পর্ক– লুণ্ঠিত হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধ। ভেঙে যাচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের আশা-আকাঙ্খা। উন্নত আদর্শবাদের চর্চার আজ বড়ই অভাব– নৈতিক মূল্যবোধের সংকট আজ সর্বগ্রাসী ও সর্বত্রচারী। সুস্থ সামাজিক চিন্তা-চেতনার অধঃপতন আর সর্বব্যাপী ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কারণে আমাদের মানসিক শক্তি তিল তিল করে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র– বেকারত্ব– দাম্পত্য কলহ– ঋণগ্রস্থ অবস্থা– সাম্প্রতিক সমস্যায় উদ্ভ্রান্ত হয়ে ক্রমাগত মানসিক চাপে সমাজের মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ার অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। আবালবৃদ্ধবণিতা অধিকাংশই আজ অন্তরে অন্তরে গুমরে মরছে– ফলশ্রুতিতে মানসিকভাবে হয়ে পড়ছে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত। মনের ঈশান কোণে জমছে উদ্বেগ– দুশ্চিন্তা আর অবসাদের কালো মেঘ। আধুনিক সভ্যতার এই ঘোর মানবিক সংকটে মেঘমুক্ত রৌদ্রকরজ্জ্বল আকাশের তলায় দাঁড়াতে হলে আমাদের সবাইকে আজ মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনের মহান পতাকাতলে সমবেত হতে হবে। শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় সর্বাত্মকভাবে আত্মনিয়োগ করার শপথ নিতে হবে। এই উদ্যোগ শুধুমাত্র মনোসমীক্ষক– মনোবিদ– মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আর মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচেষ্টায় সফলকাম করা সম্ভব নয়। সুস্থ সমাজ-জীবনের স্বার্থে এই কর্মকাণ্ডে শিক্ষক– আইনজীবী– পুলিশ-প্রশাসন– রাজনীতিবিদ– সংবাদ-মাধ্যম সবাইকে যৌথ প্রয়াসের অংশীদার হিসাবে গঠনমূলক ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। পাশাপাশি বৃহত্তর সমাজের সর্বস্তরের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজনকে মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষার এই আন্দোলনে সমানতালে পা মেলাতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় বিশেষভাবে শিক্ষক-সমাজের কর্তব্য ও দায়িত্ব অপরিসীম। আমাদের দেশে জনসাধারণের মধ্যে মনোরোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর বড়ই অভাব। আমজনতার এই অজ্ঞতা ও অজ্ঞানতাই বহুবিধ মানসিক রোগের প্রতিকার ও সামগ্রিক মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা। এই বাধা অতিক্রম করার ক্ষেত্রে সহমর্মী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান যুগে চূড়ান্ত সামাজিকসাংস্কৃতিক অধঃপতনের কারণে বাল্য-কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালের ছেলে-মেয়েরা তাদের চারপাশের অসুস্থ মানসিক পরিবেশ থেকে বিকৃতির দীক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। সরলমতি বালক-বালিকাদের অবচেতন মনে গৃহীত সেইসব বিকৃতির প্রভাবে দিনে দিনে তারা উৎকণ্ঠা– উদ্বেগ আর মনোবিকারের উন্মাদনায় উথাল-পাথাল হতে থাকে। নিজের কামনা-বাসনার সাথে তার প্রকৃত সামর্থ্যরে সামঞ্জস্য রাখতে না পেরে মনোকষ্টে ছটফট করতে থাকে। মানসিক এই স্বাস্থ্যহানির কারণে কেউ কেউ বাস্তব থেকে পালিয়ে কল্পনার জগতে বাস করতে করতে স্কিজোফ্রেনিয়া বা চিত্তভ্রংশী বাতুলতায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে। কেউবা আবার মনোবৃত্তিগতভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে শেষমেষ অসামাজিক ব্যক্তিত্ব বিকারের শিকার হয়ে পড়ে। অনেকে আবার জীবনে কাঙ্খিতকে না পাওয়ার হতাশা থেকে মানসিক অবসাদে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। শৈশব– কৈশোর– বয়ঃসন্ধি ও যৌবনের প্রারম্ভলগ্নে ছাত্র-ছাত্রীরা বিভিন্ন জটিল মানসিক সংকট ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়। তখন তাদের সবচেয়ে আগে প্রয়োজন হয় উপযুক্ত পরামর্শ আর সস্নেহ সাহচর্য্যরে। এ ব্যাপারে সঠিক দিকনির্দেশ দিতে পারেন শিক্ষক মহাশয়– যাঁর নির্দেশিত পথে শিক্ষার্থীরা অর্জন করবে মন ও মানসিক বিষয়ে বিজ্ঞান-সম্পৃক্ত পরিণত জ্ঞান। আর সেই জ্ঞানের আলো ছাত্র-ছাত্রীদের মাধ্যমে তাদের পরিবার ও বৃহত্তর সমাজকে আলোকিত করবে। যুগে যুগে দেশে দেশে সমাজে শিক্ষকদের একটি বিশিষ্ট সম্মানীয় স্থান আছে। শিক্ষকের শিক্ষাদানের ক্ষেত্র কেবলমাত্র বিদ্যালয়ের পরিসরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়– তাঁর বিচরণক্ষেত্র বৃহত্তর সমাজ-অঙ্গণে প্রসারিত। মানসিক স্বাস্থ্য আন্দোলনে আমরা তাই সর্বস্তরে শিক্ষক সমাজের আন্তরিক অংশগ্রহণ কামনা করি। চারপাশে চোখ-কান খোলা রেখে তাকালে অভিভাবকদের মুখে শুনতে পাবেন বিভিন্ন বয়সীদের নানান মানসিক সমস্যার কথা। সন্তানের অস্বাভাবিক আচরণের বিকার-জনিত সমস্যায় অনেকেই জর্জরিত। কেউ বলছেন– প্রচণ্ড রাগ– উগ্র স্বভাব– অতি চঞ্চলতা– অপরাধ প্রবণতা ইত্যাদি সমস্যার কথা। কারুর বা মুখে শুনবেন– চুরির বাতিক– কাল্পনিক ভয়– বিকৃতকাম– নেশা-আসক্তি– মোবাইল-ফোন অ্যাডিকশন প্রভৃতি সমস্যার কথা। ছাত্র-ছাত্রীদের এইসব মনোবিকারের নিরসনে শিক্ষক মহাশয়ের সহৃদয় মানবিক আচরণ ও পরামর্শদান সবচেয়ে কার্যকরী হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষা বিষয়ক কুসংস্কার এবং মনোরোগ বিষয়ক অজ্ঞতা থেকে সমাজকে বহুলাংশে মুক্ত করতে আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে দৈনন্দিন জীবনে আমাদের অনেক কিছু করণীয় আছে। ঘরে-বাইরের প্রবল চাপ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে বের করতে হবে। শুধুমাত্র আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিবারের জন্যে যথাসময়ে সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করুন। আপনার রোজগার থেকে উদ্বৃত অংশ সঞ্চয় করলে পরবর্তীতে কোনোদিন অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হতে হবে না। মানুষে মানুষে সম্পর্কের অবনতি থেকে বেশিরভাগ দুশ্চিন্তা আর মানসিক অশান্তির জন্ম হয়। আপনার চারপাশে সবধরণের মানুষজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখুন। ঘরে-বাইরে সবার সাথে পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও বিশ্বস্ততা বজায় রাখলে মানসিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কবলে পড়তে হয় না। মদ ও অন্যান্য নেশার সামগ্রী থেকে শতহস্ত দুরে থাকুন। নেশার প্রভাবে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিনষ্ট হয়– ব্যক্তিগত জীবনে নেমে আসে প্রবল মানসিক অবসাদ। নিয়মিত ব্যায়াম– যোগাসন আর প্রাণায়াম করুন– মানসিক চাপ কেটে যাবে। সাহসের সাথে ভয়কে জয় করতে শিখুন– কেননা ভয় থেকেই জন্ম নেয় টেনশন ও উৎকণ্ঠা। সুস্থ ও স্বাভাবিক দাম্পত্য-সম্পর্ক বজায় রাখুন। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য-জীবন ভালোবাসার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার হলে তাদের সন্তান-সন্ততিরা সুস্থ সুন্দর বিকশিত মন নিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ধার-দেনা করবেন না। ক্রেডিট কার্ডে অনিয়ন্ত্রিত কেনাকাটার অভ্যাস ত্যাগ করুন। যথাসময়ে ঋণ পরিশোধ না করতে পারলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লোকজনের হাতে অপদস্থ– অপমানিত ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেই মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে কত লোক মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা করে। এছাড়া– মানসিক চাপ ও টেনশন কাটাতে শিশুদের সাথে খেলাধূলা করে সময় কাটান– সুস্থরুচির হাস্য-রসাত্মক লেখা পড়ুন বা অনুষ্ঠান দেখুন– সাইকোথেরাপিও মিউজিক থেরাপি-র সাহায্য নিন। প্রসঙ্গতঃ– শারীরিক রোগের মতই বেশীরভাগ মনোরোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব। মন নিয়ে চর্চা করুন– মানসিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক পত্রিকা-জার্নাল পড়ুন জনস্বাস্থ্য প্রসারে টেলিভিশনে মন-সংক্রান্ত অনুষ্ঠান শুনুন-- নিজের ভুল ভাঙান– আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে পরিবারের ও সমাজের অন্যদের সমৃদ্ধ করুন। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গঠনমূলক উদ্যোগের পাশাপাশি মন নিয়ে ব্যক্তিগত ও সামাজিকস্তরে সচেতনতাই একমাত্র আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখতে পারে।