মুমূর্ষু জাতির প্রাণে নবীন উদ্যম সঞ্চারকারী জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডে উল্লসিত হওয়া যায়? তবু এমন ঘটনাই ঘটেছিল এবং পশ্চিমবঙ্গেও। গান্ধিজয়ন্তীতে এ নিয়ে লিখছেন মোশারফ হোসেন
মহাত্মা গান্ধি নিহত হওয়ার খবরে বহরমপুর শহর-সহ মুর্শিদাবাদ জেলার বেশ কিছু এলাকায় একশ্রেণির লোকজন মিষ্টি বিতরণ করে আনন্দ প্রকাশ করেছিল। তবে শুধু মুর্শিদাবাদেই নয়– ভারতের আরও বহু এলাকায়ও একইকারণে ওইদিন মিষ্টি বিতরণ করে উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছিল। এই খবর আমরা পাই অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা থেকে। তিনি লিখছেন– ‘দিনটা ছিল তিরিশে জানুয়ারি– ১৯৪৮। সেসময় আমি মুর্শিদাবাদের জেলাশাসক। বহরমপুরে আমার কুঠি। বিকেল পাঁচটার পর টেনিস খেলে বাড়িতে ঢুকছি। একটু পরে পুলিশ বেতার বার্তা। Mahatma Gandhi shot dead by down-country hindu.’
পরদিন সকালে স্থানীয় এমএলএ শ্যামাপদ ভট্টাচার্য জেলাশাসক অন্নদাশঙ্করকে মিষ্টি বিরতণের ওই খবর জানিয়েছিলেন। ‘শ্যামাপদবাবু আমায় বলেন– শুনেছেন? রাত্রে এখানকার কয়েকটি বাড়িতে মিষ্টান্ন বিতরণ হয়ে গেছে! আমি তো থ। গান্ধি নিধনের সংবাদে মিষ্টান্ন বিতরণ, এটা কি ভারতবর্ষ? ভেবেছিলুম এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু জেলার নানা জায়গা থেকে খবর আসতে লাগল যে সেই রাত্রে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়েছে।?
জাতির জনক– রবীন্দ্রনাথ যাঁকে মহাত্মা বলে সম্বোধিত করেছিলেন সেই গান্ধিজির প্রত্যক্ষ হত্যাকারী নাথুরাম গডসে আজকাল অনেকের কাছেই প্রকাশ্যে পুজ্য বলে বিবেচিত। নাথুরামের নামে মন্দির গড়ে উঠেছে বলেও খবর পাওয়া গেছে। তাহলে সেদিনের পশ্চিমবঙ্গেও কি মারাঠী ঘাতক নাথুরামের আদর্শের (?) সমর্থক অনেকেই ছিলেন? তাঁদের উত্তরসুরিরাও কি এখনও এ-রাজ্যে বর্তমান? তাঁরাও কি গান্ধি-নিধনের ঘটনাটিকে আজও সমর্থনযোগ্য বলে মনে করেন? মহাত্মার জন্মদিনে এই প্রশ্নটা নতুন করে ভাবাচ্ছে। হয়তোবা পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যতের সঙ্গে এ প্রশ্নের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
‘যাত্রা তব মহাদেশ মহাকাল অতিক্রম করি।
হতাশার মায়া ভেদি লক্ষ্যপানে দুর্লঙ্ঘ দুর্গম
চলেছে দুর্জয় বলে। অতীতের ইতিহাস স্মরি
মুমূর্ষু জাতির প্রাণে সঞ্চারিলে নবীন উদ্যম’।
মহাত্মা গান্ধি সম্পর্কে এই ছিল হুমায়ুন কবিরের মূল্যায়ন। মুমূর্ষু জাতির প্রাণে নবীন উদ্যম সঞ্চারকারী মনীষীর হত্যাকাণ্ডে উল্লসিত হওয়া যায়! তবু এমন ঘটনাই ঘটেছিল এবং পশ্চিমবঙ্গেও।
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন– গান্ধি হত্যার খবর শুনে ‘চোখে আঁধার দেখি। হা ভগবান! এ কি কখনও সম্ভব? গান্ধি ভারতের আত্মা। তাঁকেই হত্যা করল একজন তাঁর স্বধর্মী। কিন্তু Down country বলতে বাংলাদেশের লোকও বোঝায়। তবে কি আততায়ী একজন বাঙালি! আমার আশঙ্কা বাঙালিও হতে পারে। বেশ কয়েকজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকে বলতে শুনেছি– গান্ধির মরে যাওয়াই ভালো। ওরা বাঙালি। নামকরা লোক। তাঁদের ধারণা দেশভাগ– প্রদেশ ভাগের মূলে আর কেউ নয়— ওই গান্ধি।’
তবে সেদিন কিছুক্ষণ পর পুলিশের পরবর্তী বেতার বার্তায় খানিক আশ্বস্ত হয়েছিলেন অনন্দাশঙ্কর। ‘পুলিশ জানিয়েছিল Name of Assassin Nathuram Godse. মহারাষ্ট্রীয় নাম। মহারাষ্ট্রই বলা হয়েছে Down country তাহলে লোকটা বাঙালি নয়। বাঁচা গেল। নইলে বাঙালির নামে চিরকলঙ্ক থেকে যেত।’
ভারত দ্বিখণ্ডিত হওয়ার জন্য বহু লোক গান্ধিকে দায়ী করেন। নাথুরাম গডসেও তাদের একজন। কিন্তু গবেষণায় জানা গেছে– বিখ্যাত নেতা লালা লাজপত রায় তাঁর মৃত্যুর পূর্বে ব্যক্ত করেছিলেন– ভারতকে দু’ভাগ করে মুসলিম সম্প্রদায়কে দিতে হবে পশ্চিম পঞ্জাব– সিন্ধুপ্রদেশ– উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পূর্ব বঙ্গ। যেহেতু এসব জায়গায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেই সময় এই নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। লাজপত রায় মুসলিম এলাকার কোনও নামকরণ করেননি। পাকিস্তান নামটা পরবর্তীকালে চৌধুরি রহমত আলি নামে এক ছাত্রের উদ্ভাবন। গান্ধি চেয়েছিলেন যে হিন্দু-মুসলমান যে-যেখানে আছে– সে-সেখানেই থাকবে। পাকিস্তানের হিন্দু পাকিস্তানে– ভারতের মুসলমান ভারতে। দেশ ভাগ হয়েছে বলে লোক ভাগ হবে না। ভারতের জনগণ এক ও অবিভাজ্য। ব্রিটিশ আমলে কোনও সম্প্রদায় স্থানচ্যুত হয়নি। মুঘল আমলেও কোনও সম্প্রদায় স্থানচ্যুত হয়নি। দেশীয় রাজ্যেও কোনও সম্প্রদায় স্থানচ্যুত হয়নি। লোক বিনিময় একটা আজব দাবি। এ কথাও লিখেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়।
কারও সঙ্গে মতান্তর হলেই তাকে খুন করতে হবে? খুন না করলেও সেই ব্যক্তির মৃত্যুর মিষ্টি বিলি করে আনন্দ প্রকাশ করতে হবে? ছি! ছি!
কত মানুষের সঙ্গেই তো মতে অমিল হয়। গণ্যমান্য থেকে সাধারণ সর্বস্তরেই। যে রবীন্দ্রনাথ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধিকে ‘মহাত্মা’ নামে ভূষিত করেছিলেন– তাঁর সঙ্গে হয়নি? এই মতান্তরের খবর আমরা পাই কাজী আবদুল ওদুদের লেখায়। একবার রবীন্দ্রনাথ লিখলেনঃ… মানুষের অন্তঃকরণ সন্ধান করছে, যা তার চারদিকে আছে তাতেই সে আসক্ত হয়ে নেই। যা তার হাতের কাছে নেই তাকে হাতের তলায় আনছে। পাথর আছে তার সামনে– তাতে সে সন্তুষ্ট নয়, লোহা আছে মাটির নীচে– সেখানে গিয়ে সে ধাক্কা দেয়— পাথরকে ঘসে মেজে তার থেকে হাতিয়ার তৈরি করা সহজ— কিন্তু তাতেও তার মন উঠল না– লোহাকে আগুনে গলিয়ে হাতুড়িতে পিটিয়ে ছাঁচে ঢালাই করে যা সবচেয়ে বাধা দেয় তাকেই আপনার সবচেয়ে অনুগত করে তুললে। মানুষের অন্তঃকরণের ধর্মই হচ্ছে এই– আপনাকে খাটিয়ে কেবল যে তার সফলতা তা নয়– তার আনন্দ, সে কেবলই উপরিতল থেকে গভীর তলে পৌঁছতে চায়– প্রত্যক্ষ ক্ষেত্র থেকে অপ্রত্যক্ষে– সহজ থেকে কঠিনে– পরাসক্তি থেকে আত্মকর্তৃত্বে– প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিচারের ব্যবস্থায়। এমনি করে সে জয়ী হয়েছে’।
বিশ্ববরেণ্য কবির এই উপলব্ধির উত্তরে কী বললেন? I doubt if the steel age is an advance upon the flint age. I am indifferent. ওদুদসাহেব গান্ধির এই বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ করেছেনঃ মানুষের হাতিয়ার পাথরের কোঠা থেকে লোহার কোঠায় এসে পৌঁছলে তার প্রকৃত উন্নতি হয় কি-না সে-সম্বন্ধে সন্দেহ আছে।
এত সবের পরও কিন্তু গান্ধিকে ‘মহাত্মা’ নামে সম্বোধিত করতে দ্বিধা করেননি রবীন্দ্রনাথ।
একটা ঘটনার কথা বলে মহাত্মা সম্পর্কে এই লেখাটা শেষ করব। তারিখটা ছিল ২৯ জানুয়ারি। ১৯৪৮ সাল। দিল্লিতে বিড়লাদের গেস্ট হাউসে অবস্থান করছেন মহাত্মা। প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস আগে স্বাধীনতা ও দেশভাগ হয়ে গেছে। পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে ভারত ও পাকিস্তান— নামের দুই নতুন রাষ্ট্র। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আসা পাঁচ-ছ’জন হিন্দু পাঠান সেদিন বিকেলে দিল্লিতে মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। তাঁরা বললেন– ‘মহাত্মা– আপনি ঘোষণা করেছিলেন– ঘটনা যাই ঘটুক না কেন– কিছুতেই ভারত ভাগ হতে দেব না। ভারত যদি ভাগ হয়– তবে তা হবে আমার মৃতদেহের ওপর। আপনার সেই ঘোষণায় আমরা আন্তরিকভাবে ভরসা করেছিলাম। সেই বিশ্বাসেই দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেছিলাম। সে বাবদ আমাদের অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়েছে– অনেক নিপীড়ণ সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু শেষমেশ ভারত তো ভাগ হয়ে গেল। আপনি রুখতে পারলেন না। আপনার মৃতদেহের ওপর দিয়েও তা হল না। আপনি দিব্যি বেঁচে রইলেন। বাপু– আপনি তো সত্যের পূজারী! অথচ এমন ঘটনা ঘটতে দিলেন! মহাত্মার কথার তো খেলাপ হওয়া উচিত নয়। আপনার কথা আপনাকে রাখতেই হবে। তাই আপনার মৃত্যু হওয়া দরকার।’
কথাগুলো শুনে বেশ কয়েক মিনিট নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন মহাত্মা। তারপর বলেছিলেন– ‘আপনারা যা বলছেন তার যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। কিন্তু স্বইচ্ছায় মৃত্যু তো আত্মহত্যা। আত্মহত্যা তো মহাপাপ। সে পাপ আমি করি কী করে। এটা সত্যি যে– যা হচ্ছে তা আমার একেবারেই মনঃপূত নয়। ঈশ্বর যদি আমাকে নিয়ে নিতেন তাহলে এই মনঃকষ্ট ও নৈতিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতাম। কিন্তু তিনি যখন আমাকে নিয়ে নেননি তখন যতই দুঃখ কষ্ট পাই তাঁর আদেশ অমান্য করে আত্মহত্যা করে মহাপাপ করি কী করে? তাছাড়া আমার অন্তঃস্বরও (Innervoice) তো আমাকে বলছে না যে মোহনদাস তুমি চলে যাও।’
ঘটনাচক্রে এর ঠিক পরদিনই বিকেলে প্রার্থনাসভায় যোগ দেওয়ার মুখে নাথুরাম গডসের রিভলভারের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন জাতির জনক। তারিখটা ৩০ জানুয়ারি– ১৯৪৮।
আরও খবর পড়ুনঃ