বছর কয়েক আগেও আর এক পরীক্ষার ফল তাঁকে ঘিরে এনেছিল আনন্দের জোয়ার। গ্রামের ছেলে তখন আইআইটিতে। কিন্তু স্বপ্ন ছিল সিভিল সার্ভিস পাস করে আইএএস হওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন মাঝপথে অধরা থেকে যায়। কারণ বাবা হঠাৎ ইন্তেকাল করেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে স্বপ্ন কীভাবে পূরণ করবেন? কিন্তু থামেননি। বাবার স্বপ্নও ছিল ছেলে আইএএস হবে। বাবার স্বপ্নপূরণ করতে জেদ আরও মাথায় চেপে বসে। অদম্য জেদের কাছে হার মেনেছে সমস্ত প্রতিকূলতা। প্রতিকূল শক্তিকে হার মানিয়ে এখন আইএএস উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের মফস্সল ছোশিয়াবস্তির বাসিন্দা মুহাম্মদ মানজহার হোসেন আনজুম ওরফে প্রিন্স।
২০২০ সালে আইএএস পরীক্ষায় গোটা ভারতের মধ্যের র্যা ঙ্ক করেছেন ১২৫। গত সপ্তাহে ফল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে গোটা শহর তো বটে– গোটা জেলা আবেগে ভাসছে। কারণ প্রিন্স জেলায় প্রথম আইএএস। স্বাভাবিকভাবে জেলার বাসিন্দারা আইএএস পেয়ে যারপরনাই খুশি। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর মহকুমা ছিল এক সময় বিহারের অন্তর্গত। ১৯৫৬ সালে বিহার থেকে বাংলায় যুক্ত হয়। এই এলাকাকে সূর্যাপুর এলাকা বলা হয়ে থাকে। এই সূর্যাপুরী মাটিরই মানুষ ২৯ বছরের প্রিন্স আনজুম।
দু’বারের চেষ্টার পর ভারতের সর্বোচ্চ সরকারি চাকরির লক্ষ্যভেদ করেছেন। ধমনীতে (বংশ পরম্পরায়) ব্যবসা থাকলেও ছেলেটির এই লক্ষ্য স্থির করে দিয়েছিলেন তাঁর বাবা মুহাম্মদ মুসলেমউদ্দিন। সেই থেকেই সাফল্যের জন্য ঘাম ঝরানো লড়াই। কেমন ছিল সেই লড়াই। আজকের সাফল্যের পর জীবনের পরবর্তী লক্ষ্য কী? পুবের কলম-এর প্রতিনিধিকে সাক্ষাৎকরে সে কথা জানালেন হবু আইএএস অফিসার প্রিন্স।
দিনকয়েক আগে প্রিন্স আনজুম তাঁর গ্রামের বাড়িতে ফিরেছেন। এখানেই তাঁর সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ‘পুবের কলম’-এর প্রতিবেদক রীনা লায়লা
কীভাবে হলেন আইএএস? কোন ভাবনা চিন্তা থেকে এই সিদ্ধান্ত?
প্রিন্সঃ ইসলামপুরের ‘দ্য স্কলার’ স্কুল থেকে মাধ্যমিক। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং পরে কানপুর আইআইটি। আর সেই সময়ে বাবা ইন্তেকাল করেন। আইআইটি পাশ করার পরে মুম্বইয়ে একটা প্রাইভেট সেক্টরে ভালো চাকরিও পাই। কিন্তু লক্ষ্য ছিল সিভিল সার্ভিস। মাধ্যমিকে ভালো ফল করার পর আমার বাবা আমায় বলতেন– আইএএস হলে টাকার চেয়ে সম্মান বেশি পাওয়া যাবে। দেশের সেবা করতে পারবে। সেদিন থেকে ওটাই আমার লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। বাবার ইন্তেকালের পরে মা নিগার সুলতানা-সহ পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা আমার পাশে ছিল সবসময়।
প্রসঙ্গত– প্রিন্সের নিকট আত্মীয় বর্তমানে রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতর ও মাদ্রাসা শিক্ষা দফতরের মন্ত্রী গোলাম রাব্বানি। আর মামা জাভেদ আলম বর্তমানে কিষানগঞ্জের সাংসদ। নানা মরহুম মুহাম্মদ আজাদও একসময় বিহারের মন্ত্রী ছিলেন। আত্মীয়রা রাজনৈতিক ঘরনার হলেও প্রিন্সকে রাজনীতির কোনও ছোঁয়া লাগেনি।
আপনারা ভাই-বোন ক’জন? তাঁরা কী করছেন?
প্রিন্সঃ আমরা তিন ভাই– এক বোন। আমার থেকে ছোট (মেজো) ইফতেকার হোসেন বর্তমানে চিকিৎসক। ছোট ভাই জিসান আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ছোট বোন ইশিকা তাসনিম নিট পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর আমাদের শিক্ষার আলোকে আলোকিত করার মূলে রয়েছেন আম্মা নিগার সুলতানা। তিনি সব সময় সাহস জুগিয়েছেন। তাই আজ হয়তো এতটা এগিয়ে আসতে পেরেছি।
বাবা যে স্বপ্নের বীজটা আপনার মনে বপন করেছিলেন– তা কীভাবে পূরণ করলেন?
প্রিন্সঃ আইআইটি শেষ করার পরই মূল প্রিপারেশন শুরু হয়।
কতক্ষণ লেখাপড়া করতেন?
প্রিন্সঃ বেশিক্ষণ নয়। দিনে ঠিক করে নিতাম কতটা পড়ব– কী পড়ব– সেটা শেষ করতে যতটা সময় লাগত ততটুকুই। তবে আমার এই লেখাপড়ার জার্নিটা ছিল বেশ সিরিয়াস এবং ধারাবাহিক অনেকদিন ধরে।
আগে দু’বার ইউপিএসসি’র পরীক্ষায় আপনি সফল হননি। এবার যে পাবেন– সেটা নিশ্চিত ছিলেন?
প্রিন্সঃ পরীক্ষা এবার খুব ভালো হয়েছিল। ইন্টারভিউটাও সুন্দর হয়েছিল। ভালো ফল হবে ভেবেছিলাম।
আচ্ছা– ইউপিএসসি-র ইন্টারভিউ কেমন হয়? আপনার অভিজ্ঞতাটা একটু বলবেন?
প্রিন্সঃ দেখুন– ইউপিএসসি-র ইন্টারভিউ কেমন হয় এ প্রশ্নের এক কথায় উত্তর নেই। কারণ– ক্যান্ডিডেট-টু-ক্যান্ডিডেট এবং ইন্টারভিউয়ার প্যানেল-টু-প্যানেল এটা আলাদা আলাদা হয়। আমারটা কেমন হয়েছিল সেটা বলতে পারি। আমার যেহেতু ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাকগ্রাউন্ড– তাই সাবজেক্ট থেকে অনেক প্রশ্ন করা হয়েছিল। আসলে এখানে পার্সোনালিটি টেস্ট হয়। ইন্টারভিউ হয় না ঠিক। তাই একদম সঠিক উত্তর দিতে হবে– এমনটা হয় না। কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিতে হয়। ইনভেনশন ও ডিসকভারির মধ্যে পার্থক্য কী– সেটা আমার থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
বাংলায় সংখ্যালঘু ছেলে-মেয়েদের ইদানীং ইউপিএসসি-র সফল প্রার্থীদের তালিকায় তেমনভাবে দেখাই যায় না– আপনার কী মনে হয়?
প্রিন্সঃ আসল কারণটা ঠিক বলতে পারব না। তবে সাকসেস রেট কম এটা না বলে আমি বলব– তারা ইউপিএসসিতে ইন্টারেস্টই দেখাচ্ছে খুব কম। আমাদের এখানকার ছেলেমেয়েদের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রতি ঝোঁক বেশি। সাধারণত সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে– তারপর চাকরিতে ঢুকে যায়।
আপনি কি পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারের?
প্রিন্সঃ হ্যাঁ। আমি আমার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই আইএএস হয়ে কাজ করতে চাই– মানুষকে সার্ভিস দিতে চাই।
যাঁরা ইউপিএসসি পরীক্ষায় সাফল্যের স্বপ্ন দেখেন– তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলবেন?
প্রিন্স: হার্ড ওয়ার্ক এবং স্মার্ট ওয়ার্ক। পরিবারের সাপোর্ট চাই। তাহলেই লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে।