আহমদ হাসান ইমরান: ফিলিস্তিনের রাফায় যা ঘটছে, ‘সভ্য দুনিয়া’ এখনও তা টেলিভিশনের পর্দায় উপভোগ করে চলেছে। তবে আগ্রহ যে একটু কমে এসেছে, তাতে সন্দেহ নেই। চার মাসেরও বেশি সময় ধরে ছোট্ট এক টুকরো ভূ-খণ্ড ফিলিস্তিনের গাজাকে তারা পুরোপুরি পদানত করতে পারল না, কাঁহাতক আর একই জিনিস দেখা যায়। তবে এর মধ্যে একটি কমন বিষয় হচ্ছে, প্রতিদিনই কমপক্ষে ২০০-৩০০ ফিলিস্তিনি শিশু, নারী, পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হচ্ছে।
ইসরাইল তার যায়নবাদী পরিকল্পনা মাফিক গাজার ২৪ লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে কমপক্ষে ১৫ লক্ষকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে রাফাহ ভূ-খণ্ডে। অবরুদ্ধ গাজায় এখন কেবলমাত্র এই একটি সীমান্ত চৌকিই খুলে দিলে বেরিয়ে যাওয়ার পথ রয়েছে।
সীমান্ত চৌকি খুলে দিলে রাফা দিয়ে মিশরে প্রবেশ করা সম্ভব। ইসরাইল এই বলে রাফা শহরে গাজার অধিবাসীদের তাড়িয়ে এনেছিল যে, আমরা রাফার দিকে কোনও আক্রমণ করব না। কিন্তু বরাবরের মতো এবারও যায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল তার প্রতিশ্রুতি রাখেনি। বরং বিমান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা দ্বারা তার জেনোসাইড অভিযান অবিরাম চালিয়ে গেছে ও যাচ্ছে। আর ক্ষুধা, তৃষ্ণা, প্রচন্ড শীত, খাবার ও চিকিৎসা বিহীন রাফার মানুষদের ভাষা অবর্ণনীয় যে, মানবেতর দুর্দশা চলছে। তা নিয়ে ইদানিং বিশ্বের সভ্যতার দাবিদার মোড়লরা আর মুখ খুলছেন না।
প্রশ্ন, চোখও কী আদৌ খুলছে? নইলে তাঁরা তো দেখতে পেতেন কীভাবে ইসরাইল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমস্ত অনুনয়, বিনয়কে উপেক্ষা করে গণহত্যা চালাচ্ছে।
ইসরাইল সবসময় হুমকি দিয়ে যাচ্ছে, এই যে আমরা রাফা অঞ্চলে প্রতিদিন ২০০-৩০০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছি, এ তো কিছুই নয়। এবার বিরাটভাবে আমরা রাফায় ঘরহারা সমবেত ফিলিস্তিনিদের উপর মৃত্যু-হামলা চালাব। কারও কথাতেই হলোকাস্ট করার লক্ষ্য থেকে আমরা বিরত হব না। ইসরাইলি বন্দিদের মুক্তি দিলে আমরা হয়তো একটু থামতে পারি। কিন্তু সকল অবস্থাতেই গাজা থেকে আমরা ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করব।
সব থেকে মজার কথা হল, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইউকে-র প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দু ঋষি সুনক মাঝে মধ্যে বলছেন, রাফায় অসহায় মানুষদের জমায়েতে হামলা করা উচিত হবে না। অন্যদিকে কিন্তু আমরিকা ও ইউকে প্রতিদিনই ইসরাইলি সেনাদের মারাত্মক সব অস্ত্রশস্ত্র, মিসাইল ও বোমার জোগান দিয়ে চলেছে অব্যাহতভাবে। কাজেই ইসরাইল জানে, এই দুই পরাশক্তি মাঝেমধ্যেই যে মিউ মিউ করছে যে, রাফায় কোনও গণহত্যা চালিও না, বাস্তবে তা লোক দেখানো মাত্র। আর পশ্চিমা শক্তিগুলি ফিলিস্তিনে জবরদখলকারী ইসরাইলকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার অর্থ এবং ভয়াবহ সব মারণাস্ত্র ও বিমান সরবরাহ না করলে ইসরাইল ফিলিস্তিনের সঙ্গে যুদ্ধে ১০ দিনও টিকে থাকতে পারবে না।
কিন্তু ৭৫ বছর ধরে প্রতি মুসিবতের সময়ই আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা হিন্দি ফিল্মের কায়দায় তেল আবিবকে বলে আসছেন, ঘাবড়াও মত্। ম্যয় হুঁ না। আর তারা তাদের এই প্রতিশ্রুতি অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলেছে।
এবারও ইসরাইলের রাফায় গণহত্যা চালাব, বার বার উচ্চারিত এই হুমকির মুখে পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি চুপচাপ রয়েছে। অথচ ইয়েমেনের আনসারুল্লাহ সশস্ত্র গোষ্ঠী লোহিত সাগরে ইসরাইলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাহাজ চলাচলে বাধা সৃষ্টি করায় ইউকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অন্যান্য খ্রিস্টান শক্তি ইয়েমেনের উপর মারাত্মক বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। মারা যাচ্ছে বহু ইয়েমেনি। কিন্তু ইসরাইলি সেনারা যে গণহত্যা চালাচ্ছে, শিশু-নারীকে হত্যা করছে তা থামানোর জন্য মানবাধিকারের ধ্বজাধারী এই দেশগুলি চুপচাপ রয়েছে। তারা কী করে পোষ্যপুত্র ইসরাইলের বা যায়নবাদী ইহুদিদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে। হত্যা ও ধ্বংসলীলা চালানোর জন্য তো রয়েছে মুসলিমরা, আর ইসলামি বিশ্ব।
এর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা আবার রাষ্ট্রসংঘের আন্তর্জাতিক আদালতে পৌঁছেছিল। তাদের আবেদন ছিল, আদালত যেন রাফায় গণহত্যা না চালানোর জন্য ইসরাইলকে নির্দেশ দেয়। আদালত বলেছে, আমরা এর আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইলকে নির্দেশ দিয়েছি, তারা যেন গণহত্যা বন্ধ করে যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। কাজেই একই কথা নতুনভাবে বলার প্রয়োজন নেই। গণহত্যা বন্ধের যে নির্দেশ আমরা দিয়েছি, তা রাফার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইহুদি কবলিত মিডিয়ার সঙ্গে ভারতীয় কয়েকটি মিডিয়াও নাচতে শুরু করেছে। বাংলায় একটি পত্রিকার অনলাইন পোর্টালের শিরোনাম হচ্ছে ‘মামলা খারিজ আন্তর্জাতিক আদালতে’। সত্যিই কী মামলা বা আবেদন খারিজ হয়েছে? পাঠক নিজেরাই বিচার করে দেখতে পারেন।