পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে দলিতদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অত্যাচার যে কোনও প্রগতিশীল ও সভ্য সমাজের জন্য উদ্বেগজনক। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো দ্বারা প্রকাশিত ‘ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া, ২০২২’ রিপোর্ট অনুসারে, দলিতদের বিরুদ্ধে নৃশংসতা আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বহুগুণ বেড়েছে। দলিতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ নৃশংসতার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে এমন আটটি রাজ্য হল— উত্তরপ্রদেশ (১৫,৩৬৮টি), রাজস্থান (৮,৯৫২টি), মধ্যপ্রদেশ (৭,৭৩৩টি), বিহার (৬,৫০৯টি), ওড়িশা (২,৯০২টি), মহারাষ্ট্র (২,৭৪৩টি), অন্ধ্রপ্রদেশ (২,৩১৫টি) এবং কর্ণাটক (১,৯৭৭টি)। এই তথ্যগুলিই ইঙ্গিত দেয় যে, দলিতদের বিরুদ্ধে অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ, পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের অধীনে রাজস্থান এবং আরজেডি-জেডিইউ জোটের অধীনে বিহার দলিতদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা কমাতে পারেনি। যদিও তাদের সামাজিক ন্যায়বিচারের দাবি জেডিইউ ও আরজেডি’র দীর্ঘদিনের এজেন্ডা। দলিতরা যে সমস্যাগুলির মুখোমুখি হয় তা কেবল নির্বাচনী বা রাজনৈতিক পরিভাষায় সমাধান করা যায় না। দেশে দলিত সমস্যার প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং কাঠামোগত ক্ষেত্রে অনেক গভীরে। সাংবিধানিক সুরক্ষা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব সত্ত্বেও দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে। সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ও প্রথম সারির রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গেও যুক্ত দলিত রাজনৈতিক নেতারাও প্রায়শই তাদের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘটা নৃশংসতা প্রতিরোধে অনেকাংশে নীরব থেকে যায়। স্বাভাবিকভাবেই তাই প্রশ্ন উঠছে, সংবিধানে বিধান থাকা সত্ত্বেও কেন দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বাড়ছে? এর সমাধান কি?
কারণগুলো বহুমুখী। ব্রাহ্মণ্যবাদ ও বর্ণের শ্রেণীবিন্যাস। শর্তযুক্ত সামাজিক কাঠামোয় নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ হিসেবে দেখানোর বা তুলে ধরার চেষ্টা এবং দলিতদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য উচ্চ বর্ণের মধ্যে একটি সুপ্ত মনস্তাত্ত্বিক আকাঙ্খা। জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব এবং অহংকার—এই ধারণাটি কাঠামোগতভাবে, পদ্ধতিগতভাবে এবং ক্রমাগতভাবে তৈরি করা হয়েছে যা প্রায়শই সহিংসতায় পরিণত হয়। ঘোড়ায় চড়ার জন্য দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, উচ্চ বর্ণের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রকাশ্য রাস্তায় চপ্পল পরা এবং গোঁফ রাখার মতো উদাহরণগুলি উচ্চ বর্ণের দ্বারা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার চেষ্টার কিছু বহিঃপ্রকাশ মাত্র। ভারত জুড়ে সামন্ততান্ত্রিক সমীকরণগুলি জাতিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাসের সাথে জড়িত, যা ভূমি দখলের উপর ভিত্তি করে একটি ক্ষমতা-কাঠামো তৈরি করে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। অধিকাংশ দলিত ভূমিহীন শ্রমিক। অথচ, উচ্চ ও মধ্য বর্ণের সদস্যরা তুলনামূলভাবে বৃহৎ ভূমির অধিকারী। শুধুমাত্র রাজস্বের প্রধান উৎস হিসেবে তাদের দাপট রয়েছে তা নয়, বরং তাদের বর্ণ ও শ্রেণির দাপটের বহিঃপ্রকাশও যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। হাতে প্রচুর জমি থাকার কারণে এই মধ্যবর্তী জাতিগুলি গ্রামীণ, সামন্ত এবং পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। শিক্ষায়, শহরে কর্মক্ষেত্রে কোনও উল্লেখযোগ্য প্রবেশাধিকার দেখা যায় না তাদের। গ্রামীণ ক্ষেত্রে এই বিপুল জমির মালিকানা থাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব ফলানোর মানসিকতা তাদের বর্বর অপরাধ এবং সহিংসতার দিকে পরিচালিত করে। প্রধানত সামন্ত-অঞ্চলে উচ্চবর্ণের অমানবিক অত্যাচার অব্যাহত রয়েছে। দলিতদের প্রস্রাব পান করানো থেকে শুরু করে উচ্চবর্ণের লোকদের পা চাটতে বাধ্য করা র মতো ভুরিভুরি অমনাবিক ঘটনা ঘটে চলেছে। দলিতরা শোষিত শ্রমিক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং হল জাতিগত সহিংসতার সবচেয়ে প্রচলিত এবং অমানবিক রূপ যা প্রায়শই উচ্চবর্ণের শহুরে স্থানগুলিতে স্বাভাবিক কাজ হিসেবে ভাবা হয়ে থাকে। পুলিশ, আমলাতন্ত্র এবং বিচারব্যবস্থা সহ উচ্চ বর্ণ-প্রধান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর নিষ্ক্রিয়তা দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। অপরাধ করার পর শাস্তির ভয়ের অভাবও দলিতদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উৎসাহিত করে।