পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ উত্তরপ্রদেশে পুলিশি বাড়াবাড়ি, সিএএ আন্দোলন চলাকালীন মানুষের উপর অত্যাচারের কাহিনি নিয়ে একটি তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অফ সিভিল রাইটস বা এ পি সি আর।
‘উত্তরপ্রদেশে সমান নাগরিকত্বের জন্য সংগ্রাম , সর্বজনীন এফ আই আর , লুট, গ্রেফতার এবং মুসলিম সংখ্যালঘুদের হয়রানি ‘ শিরোনামে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, উত্তরপ্রদেশে পুলিশের গুলিতে ২৩ জন নিহত, ৩০০০ জন গ্রেফতার, ৫০০০ জনকে অভিযুক্ত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অফ সিভিল রাইটস বা এ পি সি আর এর ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং এই রিপোর্টটি নয়াদিল্লির প্রেসক্লাব অব ইন্ডিয়াতে বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে।
জনসংখ্যার বিচারে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন চলছে। ভোটের আগেই রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকেই খবর আসে, পরিকল্পিতভাবে মুসলিমদের ওপর সেখানে হামলা চালানো হচ্ছে এবং মারধর করে তাদের ‘জয় শ্রীরাম’ বলতেও বাধ্য করা হচ্ছে। এই ধরনের ঘটনাগুলোর ভিডিও করে তা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও – যাতে মুসলিম সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
ওই মানবাধিকার সংস্থার রিপো্টে দেখা যাচ্ছে, ভোটের আগে রাজ্যে হিন্দু-মুসলিম মেরুকরণের লক্ষ্যেই খু্ব পরিকল্পনা করে এই কান্ডগুলো ঘটানো হয়েছে – যদিও উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি এই অভিযোগ মানতে নারাজ। ২০২১ সালের মার্চের মাঝামাঝি, দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদের একটি হিন্দু মন্দিরে ঢুকে জল খাওয়ার অপরাধে বারো-তেরো বছরের একটি ছেলেকে মাটিতে ফেলে নৃশংসভাবে মারধর করছিল দু’তিনজন যুবক। বাচ্চা ছেলেটির নাম আসিফ, বাবার নাম হাবিব – এটা শোনার পর বেধড়ক মারের পাশে চলতে থাকে অকথ্য গালিগালাজ। মোবাইল ফোনে গোটা ঘটনার ভিডিও করে পরে হোয়াটসঅ্যাপে আর ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়ে ওই যুবকরাই। যার হেনস্থার ভিডিও দেখে গোটা দেশ শিউড়ে উঠেছিল, সেই আসিফ পরে জানায় শুধু মুসলিম হওয়ার জন্যই তাকে সেদিন ওভাবে মার খেতে হয়েছিল।
‘প্রথমে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে পেটায়, তারপর হাত-পা মুচড়ে দিয়ে লাথি মারতে থাকে আমাকে।’
বাবার সঙ্গে মিলে রাস্তার ময়লা কুড়িয়ে বাঁচা ছেলেটি ভয়ে কাঁপাতে কাঁপতে আরও বলেছিল, হিন্দুরা তাদের বাড়িতে এলে সে নিশ্চয় জল খাওয়াবে – কিন্তু কোনওদিন আর ভুলেও কোনও মন্দিরে জল খেতে ঢুকবে না।
এর মাস তিনেক পরেই গাজিয়াবাদের কাছে লোনিতে সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ আবদুস সামাদকে একটি নির্জন জায়গায় টেনে নিয়ে গিয়ে প্রবল মারধর করা হয়। জোর করে তাকে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হয়, কাঁচি দিয়ে কেটে দেওয়া হয় লম্বা দাড়ি – আর এখানেও ভিডিও ধারণ করা হয় গোটা ঘটনাটির। প্রবীণ মানুষটি কাঁদতে কাঁদতে পরে জানিয়েছিলেন, ‘ওরা শুধু আমাকে শ্রীরাম শ্রীরামই বলায়নি, বারবার বলছিল, করবি আর পাকিস্তানের দালালি?’
পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের যে মুজফফরনগর ও শামলিতে আট বছর আগের দাঙ্গায় শত শত মুসলিম ঘরছাড়া হয়েছিলেন, সেখানেও হালে আবার ফিরে এসেছে সেই দু:স্বপ্নের স্মৃতি। ‘মকতুব’ নামে একটি এনজিও-র হয়ে সেখানে দাঙ্গাপীড়িতদের মধ্যে বহুদিন ধরে কাজ করছেন রাবিহা আবদুররহিম।
সেই রাবিহা জানাচ্ছেন, মুসলিম ছেলেদের মারধর করে বা মেয়েদের হেনস্তা করে তার ভিডিও তুলে রাখার ঘটনা সেখানে আখছার ঘটেছে। শুধু তাই নয়, ওই এলাকার গ্রামে গ্রামে হিন্দু জাঠরা বড় বড় জমায়েত বা মহাপঞ্চায়েত ডেকে সেই সব নির্যাতন উদযাপন করছেন, মুসলিমদের প্রকাশ্য হুমকি দেয়া হচ্ছে। রাবিহার কথায়, ‘মুসলিমদের লিঞ্চিং উপেক্ষা করা বা চুপচাপ বরদাস্ত করা এক জিনিস – কিন্তু হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়ে মুসলিমদের হত্যাকে সমর্থন করছে, উৎসব করছে – ভাবা যায়? এতো গণহত্যার প্রথম ধাপ!’
উত্তরপ্রদেশের নয়ডাতে একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা লোকজন মেরে অজ্ঞান করে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল প্রবীণ কাজিম আহমেদকেও। লম্বা দাড়ি আর ফেজ টুপি থেকে তাকে খুব সহজেই চেনা যায় মুসলিম বলে – আর সে জন্যই তাকে নিশানা করেছিল হামলাকারীরা।
কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে ফেরা আহমেদ পরে বলেন, ‘আলিগড়ের বাসের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম – তখন ওই গাড়িটি এগিয়ে এসে আমায় লিফট দিতে চায়। কিন্তু আমায় গাড়িতে তুলেই যখন ওরা জানালার কালো কাঁচ নামিয়ে দেয়, তখনই আমি প্রমাদ গুনি। নামিয়ে দেয়ার জন্য কাকুতি-মিনতি করলেও তাতে ওরা কান দেয়নি, আমার দাড়ি টেনে ধরে একধারসে কিল-চড়-ঘুষি মারতে থাকে – দিতে থাকে খুব খারাপ গালাগালি!’
কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতা যোগী আদিত্যনাথের আমলে উত্তরপ্রদেশে এই ধরনের ঘটনা এখন এতটাই ডালভাত হয়ে গেছে যে এখন মিডিয়াতেও এসব খবর ঠাঁই পায় না বললেই চলে। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই রাজ্যটিতে বিধানসভা ভোট এখন চলছে।