এ হাসান
মোহন ভাগবত যে সে ব্যক্তি নন। তিনি সরসংঘচালক। আরএসএস এবং সংঘ-পরিবারের চালন কর্তা– সেইসঙ্গে পালন কর্তাও। হঠাৎ তাঁর একটি বক্তব্য নিউজ চ্যানেলগুলি ছাড়াও সংবাদপত্রেরও হেডলাইনে উঠে এসেছে। অবশ্য তা খবর কাগজের প্রথম পাতাতেই আসার যোগ্য। কারণ– মোহন ভাগবত বলেছেন– লিঞ্চিং যারা করছে তারা হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কাজ করছে। একথা বলার পরই তিনি মুসলিমদের উদ্দেশে বাণী রাখেন। বলেন– মুসলিমদের ভয়ের বৃত্তে আটকে থাকা উচিত নয়। একথাও ভাবা উচিত নয় যে– ভারতে ইসলাম খতরা বা বিপদের মধ্যে রয়েছে। আরএসএস-এর মুসলিম সংগঠন ‘মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ’-এর এক অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য রাখেন। মোহন ভাগবত আরও বলেন– আরাধনার পদ্ধতির জন্য মানুষকে আলাদা ভাবা উচিত নয়। ভাগবত দুঃখ করে বলেন– যদিও কিছু লোকের নামে লিঞ্চিং-এর মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে কিন্তু লিঞ্চিংকারীরা হিন্দুত্বের বিরোধী। মোহন ভাগবত আরও বলেন– হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের সমাধান হচ্ছে সংলাপ– সংঘাত নয়। আরএসএস প্রধান আরও বলেন– যদি কোনও লোক বলে মুসলিমদের ভারতে থাকা উচিত নয় তবে সে হিন্দু নয়।
খুব ভালো কথা। এই ধরনের কথাকে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আশ্রমে ‘সাধু সাধু’ বলে অভিনন্দিত করা হত। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে– বিগত কয়েক বছর ধরে সম্ভবত এমন একটি দিনও যায়নি যেদিন মুসলিমদের বিরুদ্ধে লিঞ্চিংয়ের ঘটনা ঘটেনি। কখনও গো-হত্যা– কখনও গরু পাচার– কখনও বা হিন্দু মহল্লায় সবজি বিক্রির অভিযোগে মুসলিমদের নির্দয় প্রহার ও নির্মম হত্যা করা জারি রয়েছে। যারা এই মানুষের হত্যা ও নির্যাতনে জড়িত রয়েছে তারা সকলেই সংঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। কেউ বজরং– কেউ বিশ্বহিন্দু পরিষদ আবার কেউ বা বিজেপি সমর্থক। তাই অনেকেই প্রশ্ন করছেন– মোহন ভাগবত কি এদের সংযত হওয়ার জন্য কোমল বার্তা দিয়েছেন,
সম্ভবত এইসব লিঞ্চিংয়ের ঘটনায় বিদেশে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে কিংবা মানবাধিকার সংস্থাগুলি যেভাবে এই নির্মম ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তাতে হয়তো সরসংঘচালক মোহন ভাগবত সামান্য হলেও লজ্জা পেয়েছেন। তাই সংঘ পরিবারের সমর্থকদের এইসব কর্মকাণ্ড থেকে নিজেদের নাম বিযুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি লাগাতার এই নৃশংস ঘটনাবলীর নিন্দা করেননি।
তবে মোহন ভাগবত দাবি করতেই পারেন– আরএসএস-এর তাত্ত্বিক নেতারা মুসলিমদের হত্যা করতে বলেননি– বলেছিলেন মুসলিমদের ভারতে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বাস করতে হবে। তাই যখন সংখ্যালঘু মুসলিমদের সংঘ পরিবারের সমর্থকরা লাগাতার হত্যালীলায় মেতে উঠেছে– মোহন ভাগবতজীর তাতে হয়তো খানিকটা লজ্জা হচ্ছে। তাই সমর্থকদের নিন্দা না করে তিনি তাদের প্রতি মৃদু ও কোমল বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু বাংলায় একটি কথা আছে– ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না’। যারা প্রতিনিয়ত লাঠি প্রদর্শনী– কুচকাওয়াজ ও অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন– তাদেরকে এইসব কথা বলে আটকানো সম্ভব নয়। প্রয়োজন ছিল যারা এইভাবে আইনকে হাতে তুলে নেবে– হত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞে লিপ্ত হবে তাদেরকে খুনী ও অপরাধী বলে অভিহিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তা না করে ভাসা ভাসা কথা বললে সমর্থকরূপী ভবি-রা যে ভুলবে না তা বলাই বাহুল্য। মুসলিম– খ্রিষ্টান ও শিখরা ভারতের ভূমিপুত্র। তাদের হেও করা– তাদের উপর হামলা ও ধ্বংস-যজ্ঞ চালানো কিংবা মারপিট করে হত্যা করা সম্পূর্ণ আইন বহির্ভূত। সংঘ পরিবারের এই খুনী সমর্থকদের একমাত্র শাস্তি হওয়া উচিত মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা প্রয়োজন। আর এই বার্তা দেওয়া প্রয়োজন– এইসব অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই। কিন্তু অনেক সময় দেখা গেছে এইসব হত্যাকারীরা জামিন পেলে স্বয়ং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তাদেরকে স্বাগত জানানোর জন্য ফুল মালা নিয়ে জেল গেটে হাজির থাকছেন। তবে মোহন ভাগবতের বক্তব্যে একটা সত্য উঠে এসেছে যে– সংঘ পরিবারের সমর্থকরাই সংখ্যালঘুদের লিঞ্চিং ও ধ্বংস-যজ্ঞের জন্য দায়ী। তাই সরসংঘচালক মোহন ভাগবতজী এতদিন পর এই বার্তা দিয়েছেন যে– তারা যদি লিঞ্চিং বা হত্যায় লিপ্ত হয় তবে ‘তারা হিন্দু নয়’। কিন্তু এই ধরনের বাক্য বিতরণে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। উগ্র হত্যাকারীরা এর ফলে যে বিরত হবে না– তা বলাই বাহুল্য। তবুও মন্দের ভালো– নিজ সমর্থকদের প্রতি তিনি কোমল হলেও এক বার্তা দিয়েছেন।
তবে এর দ্বারা পরিবারের সমর্থকরা সংযত হবে কি না তাতে ঘোরতর সন্দেহ আছে। অবশ্য একটা ইস্যুতে মোহন ভাগবতের প্রশংসা করতেই হবে। আর তা হল– তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন সংঘ পরিবারের সমর্থকরাই এই ধরনের হত্যা ও প্রহারের জন্য দায়ী।