আহমদ আবদুল্লাহ: প্রধানমন্ত্রী মোদিজির মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ এখন সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। রাজস্থানে অবস্থা বেগতিক দেখে প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস দলের প্রতি আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি তাঁর ‘প্রিয় বিষয়’ ভারতের মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ প্রচারকে একেবারে তুঙ্গে নিয়ে গেছেন। মুসলিমদের তিনি বলেছেন, ‘ঘুসপেটিয়া’, ‘যাদের বেশি বাচ্চা হয়’ এবং ‘এরা (মুসলিমরা) মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র কেড়ে নেবে’।
দেশের একটি জাতি-গোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচারের জন্য এর থেকে বেশি আর কী বলা যেতে পারে! ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা এখন কম করে হলেও ২০ কোটি। প্রধানমন্ত্রীর এইসব বক্তব্য শুধু ঘৃণা প্রচার নয়, মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্যও যথেষ্ট। ভারতের মতো সংবেদনশীল দেশে এই ধরনের বক্তব্য যে সংবিধান বিরোধী, নাগরিক ও মানবিক অধিকার বিরোধী এবং চলমান নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোড অফ কনডাক্ট বা নির্বাচনী আচরণবিধি বিরোধী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নরেন্দ্র মোদি এবং তার প্রিয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইদানীং বার বার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, নির্বাচনে তাঁরা জয়ী হলেও সংবিধানে কোনও পরিবর্তন করবেন না। কিন্তু বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী মোদিজি মুসলিমদের প্রতি এই ধরনের শব্দ ব্যবহার করে অবশ্যই দেশের সংবিধানের বড় ধরনের উল্লঙ্ঘন করেছেন। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, লোকে বলছে, ‘আগে আগে দেখিয়ে হোতা হ্যায় কিয়া’।
সম্প্রতি মণিপুরে যেভাবে হত্যা, নারীদের অপমান, কয়েক শত চার্চ পোড়ানো হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় এখনও সুবিচার পায়নি তা কোন দিকে ইঙ্গিত করে? ভারতের মুসলিমদের মাদ্রাসা শিক্ষার উপর আঘাত আসছে যা সম্পূর্ণ সংবিধান বিরোধী।
অসমে ১২৫ বছরের পুরনো মাদ্রাসাগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যদিও এইসব মাদ্রাসাতে সরকারি স্কুলের সিলেবাস পড়ানো হত এবং নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে তা ব্যাপক ভূমিকা রাখছিল। নানাভাবে অসমে মুসলিমদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। ভারতের রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও অন্যান্য রাজ্যে বাল্যবিবাহ এখনও গুরুতর সমস্যা। অথচ অসমে ১৬-১৭ বছর বয়সেও যেসব মেয়েদের বিয়ে হয়েছে, তাদের স্বামীদের ধরে ধরে সব জেলে পাঠানো হচ্ছে। ১০ বছর আগে বিয়ে হলেও তাদের ‘হুউচ হান্টিং’ করে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং জেলে পাঠানো হচ্ছে। এতে বিবাহিত মেয়েগুলির অবস্থা খুবই শোচনীয়।
রোজগেরে স্বামী জেলে যাওয়ায় এই পরিবারগুলি কেমন করে চলছে তা খোদায় মালুম। এসবই কিন্তু সংবিধানের লঙ্ঘন। কাজেই ক্ষমতায় থাকলে আর সংবিধান পালটানোর দরকার কী? তারা তো মুখে সংবিধানের গুণগান করে বাস্তবে হাসতে হাসতে সংবিধানের ভোল পালটে দিচ্ছেন। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, দেখা যাচ্ছে মোদিজি তাঁর দাবি মতো ‘বিশ্বগুরু’ নন, বরং তিনি ‘বিষগুরু’ হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন রয়েছেন। আর ‘আপনাদের সম্পদ ও মঙ্গলসূত্র মুসলিমরা ছিনিয়ে নেবে’ এই ধরনের অলীক বক্তব্যের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন কংগ্রেসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ২০০৬ সালে একটি মন্তব্যকে।
যেখানে মনমোহন সিং বলেছিলেন, দরিদ্র, দুর্বল শ্রেণি ও অধিকার বঞ্চিত মানুষদের দেশের সম্পদে প্রথম অধিকার রয়েছে। আর পিছিয়েপড়া মুসলিমদের এক্ষেত্রে রয়েছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একজন প্রধানমন্ত্রী যাকে দেশ-বিদেশে অনেকেই শ্রদ্ধা করেন তাঁর বক্তব্যকে টেনেটুনে নিজের মতলবের জন্য মোদিজি সম্পূর্ণ বিকৃত করেছেন এবং ব্যবহার করেছেন নির্বাচনে জাতি বিদ্বেষ প্রচার করে ভোটে বিজেপির জন্য সুবিধা হাসিল করার কাজে।
তাই প্রিয়াঙ্কা গান্ধি এবং অখিলেশ যাদব দু’জনেই দেশের দু’টি বড় দলের নেতা-নেত্রী তাঁরা সাবধান বাণী উচ্চারণ করেছেন। প্রিয়াঙ্কা বলেছেন, দেশের সবচেয়ে বড় নেতা নৈতিকতা পরিত্যাগ করেছেন, জনগণের সামনে নাটক করছেন এবং তা করতে গিয়ে মোটেই সত্যের পথে পদচারণা করছেন না। স্পষ্টই প্রিয়াঙ্কা এই মন্তব্য করেছেন মোদিজি সম্পর্কে।
এর মধ্যে অখিলেশ যাদবও রাজস্থানে নরেন্দ্র মোদির সেই কুখ্যাত ভাষণ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন যে, আপনাদের বহু মেহনতের অর্জিত টাকা-পয়সা, সম্পত্তি ঘুসপেটিয়াদের দিয়ে দেওয়া হবে, এই ধরনের কথা বলে প্রধানমন্ত্রী মোদি শুধু নিজেকে নয়, দেশকেও ছোট করেছেন। তবে অখিলেশের বক্তব্য, বিজেপির মিথ্যা প্রচার সত্য দিয়ে মোকাবিলা করা যায় কিন্তু সত্য কথাগুলি ইদানীং মিডিয়া প্রচার করে না।
তিনি আরও বলেন, মোদির সহযোগী ইউপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, কংগ্রেস মুসলিমদের শরীয়া আইনকে সারাদেশে লাগু করতে চায়। আসলে বিষয়টি হল, কংগ্রেস কখনই এই ধরনের কোনও কথা লিখিতভাবে কিংবা মুখে বলেনি। কিন্তু যোগী বা মোদির মিথ্যা প্রোপাগন্ডা করতে অসুবিধা কোথায়? তাঁরা যাই বলবেন মিডিয়া তা হইহই করে প্রচার করবে।
আর কংগ্রেসের ইশতেহারে কোথাও হিন্দু-মুসলিমের কোনও কথাই নেই। কিন্তু মোদি নির্বিকারভাবে কংগ্রেসের ইশতেহারের উদ্ধৃতি দিয়ে বলে দিলেন, কংগ্রেস আপনাদের সম্পদ নিয়ে মুসলিম ঘুসপেটিয়াদের মধ্যে বিলি করে দেবে।
এ কথাটি মোদির সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা। আসলে হয়তো তিনি চান, কংগ্রেস নিজের ইশতেহারে এই কথাগুলি লিখুক! না লিখলেও মোদিজি তো আছেন। তিনি নিজের গেরুয়া মস্তিষ্ক থেকে অলীক ও বানোয়াট ‘কংগ্রেস ইশতেহারের’ কথা প্রচার করবেন। তারপর কেই বা তা খতিয়ে দেখবে।
বলা হচ্ছে, মোদিজি বুঝতে পেরেছেন এবার ভোটাররা তাঁর দলকে জয়ী নাও করতে পারে। অন্তত প্রথম পর্যায়ের ভোটে তারই স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তাই তিনি এখন গোয়েবলস-এর নীতি অনুসরণ করতে লেগেছেন।