অপূর্বানন্দ
এটা দুঃখজনক যে ভারতের রাজনৈতিক নেতা বা দলগুলি চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াতের বিবৃতির কোনও জোর প্রতিক্রিয়া জানায়নি। মূলধারার মিডিয়াকেও বিপিন রাওয়াতের বক্তব্য নিয়ে নীরব থাকতে দেখা গিয়েছে। সম্প্রতি একটি মিডিয়া ইভেন্টে বক্তৃতাকালে রাওয়াত বলেন যে, কাশ্মীরিরা এখন সন্ত্রাসীদের নিজেরাই পিটিয়ে হত্যা করার কথা বলছে। তিনি দাবি করেছেন, এটি খুব ইতিবাচক লক্ষণ। কাশ্মীরের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এইসব কথা তিনি জানতে পেরেছেন। এরপরে রাওয়াত যা বলেন তা আরও ভয়ঙ্কর। তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর ঢাল হিসাবে কাশ্মীরের জনগণকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। তিনি দাবি করেছেন যে কাশ্মীরিরা লিঞ্চিং হতে বা তাদের যাতে পিটিয়ে মারা হয়, এমন ব্যবস্থা করারও প্রস্তাব দিয়েছিল। চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ রাওয়াত দেশের প্রতিরক্ষার প্রধান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন, তিনি এখন হিংসার ভাষায় কথা বলছেন। এতে আমাদের সকলের উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। এই ধরনের সহিংসতাকে তিনি সমর্থন করেছেন এবং সেদিন সেমিনার হলে অভিজাত দর্শক শ্রোতাদের কাছ থেকে সাধুবাদও পেয়েছেন। জেনারেলের বক্তব্যের তাৎপর্য অত্যন্ত ভীতিজনক। তিনি বলতে চেয়েছেন, কাশ্মীরিরা স্থানীয়দের হাতেই মৃত্যুবরণ করছেন। কাশ্মীরিদের গুলিতে মৃত্যুর জন্য দায়ী কাশ্মীরিরাই। তাহলে তাঁদের রক্ষা করবে কে? পুলিশ নাকি সেনা?
জেনারেল রাওয়াত ২০১৭ সালের এক ঘটনায় একজন কাশ্মীরিকে মানব ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার প্রশংসা করেছিলেন। তিনি আরও পরামর্শ দিয়েছিলেন যে জঙ্গিবাদকে সমর্থনকারী বেসামরিক ব্যক্তিদেরকেও সেনাবাহিনীর হাত থেকে রেহাই দেওয়া হবে না। একাধিকবার তিনি ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির মতাদর্শকে সমর্থন করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান এবং নাগরিকদের রক্ষক। তাঁর এই ধরণের মন্তব্যে দেশের নাগরিকদের সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস কিন্তু নড়ে যেতে পারে।
একজন আইনজীবীর মতে, জেনারেল রাওয়াত লিঞ্চিংয়ের বিষয়ে তাঁর প্রকাশ্য মন্তব্যে আদালতের স্পষ্ট অবমাননা করেছেন। ওই আইনজীবী তেহসিন এস পুনাওয়ালা বনাম কেন্দ্র সরকার মামলা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিকে ইঙ্গিত করেন, যেখানে আদালত দ্ব্যর্থহীনভাবে স্পষ্ট করেছে যে লিঞ্চিং বেআইনি এবং অপরাধমূলক কাজ।
আদালত বলেছে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পিটিয়ে হত্যা করাকে কখনই অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না। নাগরিকদের হিংসা থেকে রক্ষা করার জন্য অবশ্যই প্রশাসনকে আন্তরিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। একে ‘নিউ নরমাল’হয়ে উঠতে দেওয়া যাবে না।
আদালত উল্লেখ করেছে যে, আইন নাগরিকদের অধিকার প্রদান করেছে। তবে একটি সভ্য সমাজে সামাজিক আচরণও নিয়ন্ত্রিত করে আইন। আইনের প্রাথমিক লক্ষ্য হল একটি সুশৃঙ্খল সমাজ, যেখানে নাগরিকের পরিবর্তন ও অগ্রগতির স্বপ্নগুলি বাস্তবায়িত হয় এবং ব্যক্তি আকাঙ্খা তার সম্ভাবনা প্রকাশের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পায়। এমন পরিবেশে প্রতিটি নাগরিক যখন সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ আইন প্রদত্ত অধিকার ও স্বার্থ ভোগ করার অধিকারী, তখন তিনি আইনের আদেশের প্রতি আনুগত্য করতেও বাধ্য।
আমরা মনে করি, জেনারেলের দৃষ্টিভঙ্গি তাৎক্ষণিক ন্যায়বিচারের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠের মতকেই সমর্থন করছে। তাদের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে যে ‘সন্ত্রাসীদের’ নাগরিক হিসাবে গণ্য করা যায় না। যারা আইন প্রক্রিয়ার প্রতি কোনও গুরুত্ব দেয় না এবং যাদের মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে কোনও বাছবিচার নেই, তারা এই সাংবিধানিক ন্যায়পরায়ণের নীতির সুবিধাভোগী হতে পারে না। লিঞ্চিং-এর পক্ষে কি এই যুক্তি সমর্থনযোগ্য?
এখানেই চ্যালেঞ্জ নিহিত রয়েছে। যখন আইন সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে এবং সন্ত্রাস মোকাবিলা করার জন্য ব্যবহৃত হয়– তখন রাষ্ট্রকে অবশ্যই দেখতে হবে যে এটি যেন সন্ত্রাসীদের পদ্ধতিকে সমর্থন না করে বা সন্ত্রাসীদের ভাষায় কথা না বলে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কখনই দুর্বৃত্ত হতে পারে না, যত চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন।
জেনারেল রাওয়াতের দৃষ্টিভঙ্গি কাশ্মীরের জন্য অবশ্যই বিপজ্জনক। জম্মু-কাশ্মীরে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে প্রশাসনের কাজকর্মে ক্ষুব্ধ অনেক যুবক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণ তাদের অসহায়ত্ব ও হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত করেছে। তারা নিজেদেরকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ভারতীয় রাষ্ট্রের অধীনস্থ বলে মনে করে এবং ভিন্নমত প্রকাশের কোনও বৈধ উপায় তাদের কাছে নেই, এটাই তাদের মত।
রাওয়াতের অবস্থান ভারতজুড়ে বসবাসকারী মুসলমানদের জন্য অবশ্যই বিপজ্জনক। বিজেপি সরকারের আমলে হিন্দু উগ্রপন্থী প্রচার ক্রমশই বাড়ছে। কোথাও কোথাও ইসলাম অনুসরণকারীদের সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। তাদের এই প্রোপাগান্ডা অনুযায়ী, বন্দুক ও তরবারির ভাষায় ‘সন্ত্রাসীদের’মোকাবিলা করতে হবে। কাশ্মীরের মানুষের অভিযোগ, তাদের নাগরিক মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে। রাষ্ট্র তাদের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করছে। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, কাশ্মীরি সাংবাদিকদের উপরও নির্যাতন করা হয় এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সামান্য অজুহাতে চাকরি থেকে নির্বিচারে বরখাস্ত করা হচ্ছে! এমনকি ভারতপন্থী মূল ধারার কাশ্মীরি রাজনীতিবিদদেরও অপমানিত করা হয়েছে ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করার পর। অপরদিকে জম্মুকাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়ার পরও আদালত এই অন্যায় থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কাশ্মীরিদের কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়নি।
জম্মু-কাশ্মীরের সব ধর্মের মানুষ বিশ্বাস করে যে কেন্দ্র কাশ্মীরি জনগণের কাছ থেকে এই অঞ্চলটি কেড়ে নিতে পারলেই খুশি হবে। ভারতীয়দের জন্য কাশ্মীর যেন একটি পর্যটন গন্তব্য– যা তাদের নান্দনিক আনন্দ মেটায় মাত্র। সাহিত্যিক মুন্সি প্রেমচাঁদ অনেক আগেই বলেছেন– কোনও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন সম্প্রদায় নীরবে তার মর্যাদার লুণ্ঠন সহ্য করতে পারে না। তবুও কাশ্মীরিরা দেখছে রাষ্ট্র এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের আত্মমর্যাদা প্রতিদিন কমে যাচ্ছে। অনেকেই ভিন্ন পথের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছে। তারা ভারতীয় রাষ্ট্রকে তাদের সঙ্গে, তাদের মতো করে কথা শুনতে বাধ্য করতে চাইছে। যদিও এটি খুবই ধ্বংসাত্মক উদ্যোগ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির এই নিষ্ঠুরতা কাশ্মীরে ‘সন্ত্রাসী’ তৈরিতে অবদান রেখেছে। অবশ্যই সন্ত্রাসবাদের নিজস্ব যুক্তি আছে। কিন্তু রাষ্ট্র তার দায় এড়াতে পারে না। এই প্রসঙ্গে সন্ত্রাসী শব্দ ব্যবহারের অসুবিধা বোঝানোর জন্য আমি এই সব লিখছি। যিনি একজন সন্ত্রাসী, কেন আমরা তাকে নাগরিক সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর জন্য সম্ভাব্য সব উপায় ব্যবহার করব না? তবে এর জন্য আমাদের সহনশীল থাকতে হবে। জেনারেল রাওয়াত সংখ্যাগরিষ্ঠের মধ্যে জনপ্রিয়তা ও বাহবা পেতে লিঞ্চিং-এর সমর্থনে একটি পপুলিস্ট যুক্তি তৈরি করছেন। এটা বিপজ্জনক এবং কখনই এমন অনুমতি দেওয়া যেতে পারে না। তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন– তিনি ভারতের সংবিধান এবং এর আইনের প্রতি দায়বদ্ধ।