বিশেষ প্রতিবেদনঃ সম্ভবত ভারতের আর কোনও শাসককে ব্রিটিশ মিডিয়া এতবেশি প্রচার দেয়নি– যতটা প্রচার দিয়েছে ফেতেহ আলি সাহাব (টিপু)-কে। যিনি টিপু সুলতান নামে সারা দেশে পরিচিত। টিপু সুলতান জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৭৫০ সালে দেভান হাল্লিতে। আর শহিদ হন সেরিনগা পট্টমে ১৭৯৯ সালের মে মাসের ৪ তারিখে। ব্রিটিশ আরকাইভস সম্প্রতি টিপু সুলতানের ১৭৮৯ সালের তোলা প্রথম ছবিটি প্রকাশ করেছে। এটি এতদিন ছিল লন্ডন মিউজিয়ামে। এই ছবিতে ‘মহীশূরের শার্দুলকে’ তাঁর প্রকৃত আকারের ছবিতে তুলে ধরা হয়েছে। এতদিন ধরে ভারতীয়রা কখনই টিপুর প্রকৃত ছবি দেখার সুযোগ পাননি। তার সমস্ত ছবি হয়তো হাতে আঁকা কিংবা তাঁর ব্যঙ্গচিত্র।
টিপু ছিলেন ব্রিটেনের চোখে এমন এক ভারতীয়– যাকে সবাই ভয় পেত। তাঁর কাজকর্ম ব্রিটিশ মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে সম্প্রচারিত হত। ইংল্যান্ডের লোকেরা অপেক্ষায় থাকত কখন টিপু সুলতানের জুলুম বা জবরদস্তির খবর প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশদের সঙ্গে টিপু সুলতানের যে চারটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল– এটা সেই সময়ের কথা। টিপু সুলতান ব্রিটিশ জনমানসের অগ্রভাবে থাকতেন। ব্রিটিশ বাহিনীর উপর তাঁর ভয়ংকর সব হামলার গল্প এবং মাদ্রাস প্রেসিডেন্সিতে অবস্থিত ব্রিটিশ ব্যবসা কেন্দ্রগুলির উপর তাঁর হুমকির খবর প্রায়ই ব্রিটিশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত। বহু ব্রিটিশ যুদ্ধবন্দি ব্রিটেনে ফিরে এসেছিলেন। এদের কিছু জনকে মহীশূরে বেশ কয়েক বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল। এই প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে বেশ কিছু পুস্তকও ব্রিটেনে প্রকাশিত হয়। এতে থাকত ব্রিটিশ সেনাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কষ্টকর জীবন এবং অত্যাচারের ভয়ংকর ভয়ংকর সব গল্প। বলা হতো মহীশূরের সুলতান টিপুর অধীনেই এই ঘটনাগুলি ঘটেছে। এই গল্পগাঁথাগুলি থেকে একটি কথা পাঠকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল যে– টিপু একজন শক্তিশালী শাসক এবং তাঁর কাহিনীগুলি টিপুর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট ছিল। টিপু সুলতান সম্ভবত সমগ্র ইউনাইটেড কিংডমের মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত ভারতীয় ছিলেন।
টিপু সুলতান যখন তাঁর রাজধানী সেরিনগা পট্টমে ব্রিটিশ জেনারেল হ্যারিসের সেনাবাহিনীর হাতে ১৭৯৯ সালে মৃত্যু বরণ করেন– এই খবরে ব্রিটেনে আনন্দ-উৎসব শুরু হয়ে যায়। লেখক– নাট্যকার এবং চিত্র শিল্পীরা টিপু সুলতানের মৃত্যু উদ্যাপন করার জন্য নানা ধরনের রচনা– নাটক ও পেন্টিং তৈরি করেন। মহীশূরের শার্দুল টিপুর মৃত্যুতে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী– জনমানস এতটাই প্রভাবিত হয়েছিল।
টিপু সুলতান ব্র্যাঘ্রের ছবি ও মূর্তিকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতেন। এটা তিনি করতেন তাঁর বীরত্ব এবং ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। তাঁর স্বর্ণখোচিত সিংহাসনেও রয়েছে ব্যাঘ্রের প্রতিকৃতি। শুধু সিংহাসনেই নয়– তাঁর পোশাকে– মুদ্রায়– ছুরি ও তলোয়ারে এবং নিজের সৈনিক ইউনিফর্মের কাঁধে নানা আকৃতির বাঘ খোচিত থাকত। টিপুর রাজধানী অবরোধ করার ক্ষেত্রে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদেরকে মেডেল দেওয়া হয়েছিল। ওই মেডেলে খোচিত ছিল– একটি বাঘকে একটি সিংহ পরাজিত করছে। ব্রিটিশরা এর দ্বারা বোঝাতে চেয়েছিলেন– মহীশূরের শার্দুলকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সিংহের কাছে পরাজিত হতে হয়েছে। ব্রিটেনের জনগণের মনে মহীশূরের ব্যাঘ্র টিপু সুলতান উনবিংশ শতাব্দী যুগে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন। এমনকি ১৮৬৮ সালেও উইলকি কলিন্স ‘মুনস্টোন’ নামে একটি প্রখ্যাত নোভেল লেখেন। তাতে তিনি সিরিরাঙ্গাপাত্তানার অবরোধের কথা এবং জয়ের পর ব্রিটিশ সেনাদের লুঠপাটের কথা উল্লেখ করেছেন।
হিন্দু কট্টরপন্থীদের এই কথা ফের মনে করিয়ে দিতে হবে– টিপু সুলতান সর্বাংশে সেক্যুলার অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষ ছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী পূর্নাইয়া একজন ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন। শুধু তাই নয়– টিপুর দরবারে উচ্চপদে আসীন ছিলেন বহু হিন্দু। টিপু সুলতান বেশ কিছু হিন্দু মন্দিরের উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে– শ্রীরঙ্গানাথ মন্দির। যা টিপু সুলতানের রাজপ্রাসাদের সামনেই তৈরি হয়েছিল। টিপু সুলতান সিরিংগেরি মঠের স্বামীকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁকে জগৎগুরু বলে অভিহিত করেছেন। খুব শীঘ্রই হয়তো ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত টিপু সুলতানের আসল প্রতিকৃতিটি আমরা দেখতে পাব।