বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মূর্ত প্রতীক শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। উপমহাদেশের কৃষক ও সমবায় আন্দোলনের অন্যতম এই পথিকৃ্তের জন্মের সার্ধশতবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করেছেন আমিনুল ইসলাম
বিশ শতকের ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জননায়ক, মহৎ ব্যক্তিত্ব এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম স্থপতি এ কে ফজলুল হক। একমাত্র তাঁকে তুলনা করা যেতে পারে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আর এক অবিস্মরণীয় নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে। বিবিসি বাংলা বেতারের ২০০৪ সালের শ্রোতা জরিপে কুড়িজনের মধ্যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ৪র্থ স্থানে চিহ্নিত হয়েছেন এ কে ফজলুল হক। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা উপমহাদেশের রাজনীতিতে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল উচ্চতার শিখরে। অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭-৪৩) আবুল কাশেম ফজলুল হককে মনে রাখেনি ‘আত্মঘাতী বাঙালি’— এই কথা দুঃখের হলেও অতি বাস্তব।
১৭৫৭ সালের পলাশি বিপর্যয়ের পর বাংলার জনগণ প্রথম দেশ শাসনের অধিকার পায় ১৯৩৭ সালে। আমরা জানি, ১৭৯৩ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে ইংরেজ অনুগত একদল জমিদার সৃষ্টি করে তাদের মাধ্যমে সরকার রাজস্বের ব্যবস্থা করে চিরদিনের জন্য। জমিদার শ্রেণি এর ফলে ইচ্ছেমতো খাজনা ও কর আদায়-সহ যখন তখন ভূমি থেকে উৎখাত করার ক্ষমতা অর্জন করে এবং নিজের জমি হারিয়ে ভূমিদাসে পরিণত হয় কৃষকেরা। প্রায়শ ইংরেজ ও জমিদারদের অকথ্য সীমাহীন নির্মম অত্যাচার নেমে আসে তাদের ওপর। দু’ভাবে বাংলার কৃষকদের নির্দয়ভাবে শোষণ করা হ’ত, একটি ছিল জমিদারি প্রথা ও অন্যটি লগ্নির মহাজনী পদ্ধতি। আমজনতার এই দুর্দিনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এ কে ফজলুল হক ১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেই বিশেষভাবে নজর দেন শিক্ষা, কৃষি, ভূমি, শিল্প, প্রশাসন, সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়নে। জমিদার-মহাজনদের শোষণ-নিপীড়ন, লাঞ্ছনার হাত থেকে বাংলার সাধারণ কৃষক-শ্রমিকরা মুক্তি লাভের সনদ পান ফজলুল হকের শাসনে। সুদের মামলায় শত শত অসহায় কৃষককে রক্ষা করেছেন জমিদারি হয়রানি থেকে। বাংলার সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৫ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করেন মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই; অবিভক্ত বাংলায় তাঁর শাসনামল ছিল স্বর্ণযুগ।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গ্রাম-বাংলার উন্নয়নে ছিলেন পথিকৃৎ। ভূমি, কৃষি ও শিল্প সংস্কার করে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটান গ্রাম-বাংলায়। ব্রিটিশ শাসনামলে সমগ্র ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতেও তাঁর অবস্থান ছিল প্রশ্নাতীত। নিখিল ভারত কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯১৮ সালে এবং ওই বছরেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নেন তিনি। একই সঙ্গে সভাপতিত্ব করেন মুসলিম লিগ অধিবেশনে ও বিশেষ প্রতিবেদন পেশ করেন কংগ্রেস সম্মেলনে। লিগের সভাপতির ভাষণে তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে, হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রতি গুরুত্ব দেন এবং বলেন, ‘উভয় সম্প্রদায় এমন একটা বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করছে যখন প্রতিটি ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একান্ত প্রয়োজন।’
অন্যদিকে কংগ্রেস অধিবেশনে প্রতিবেদন পেশে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন, বিবাদমান হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা সাধনের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এগিয়ে চলা হচ্ছে আশু প্রয়োজন। আপসহীন ন্যায়-নীতি ও অসামান্য বাক্পটুতায় রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ গ্রাম্য মানুষের হৃদয় জয় করতে তিনি সমর্থ হয়েছিলেন অতি সহজেই; বিভিন্ন সাহসী পদক্ষেপের জন্য খেতাব অর্জন করেন— ‘শেরে বাংলা’। গ্রাম-বাংলার খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপকভাবে শিক্ষা প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ ছিল ত¥ার প্রথম পদক্ষেপ। অল্পদিনেই বোঝা যায়, এ কে ফজলুল হক সত্যিকারের একজন কিংবদন্তি এবং বাংলার আপামর জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা। শুধুমাত্র তাঁর যুগেরই যে তিনি প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন তাই-ই নয়; জাতির অনাগত বংশধরদের আশা-আকাঙ্ক্ষার জন্যও রেখে গেছেন গণতন্ত্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ, গরিবের জন্য ডাল-ভাতের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক মুক্তি।
এ কে ফজলুল হক তাঁর স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কর্মজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ধরে রেখেছিলেন উজ্জ্বল সাফল্যের ধারাবাহিকতা। বরিশালে আর্থ-সামাজিক পরিবেশে নিজেকে সুসংহতভাবে গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সময়ে। বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, সংস্কৃত গণিত-সহ সব বিষয়েই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১ম বিভাগে জেলা স্কুল থেকে অর্জন করেন বিভাগীয় বৃত্তি ও স্বর্ণ পদক। পরবর্তীতেও তাঁর শিক্ষায় মেধা ও প্রতিভা ছিল ঔজ্জ্বলতায় ভরা এবং সেই সময়ের তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে এক আলোকিত অনুপ্রেরণার মানুষ। প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন বাবার একান্ত বন্ধু রসায়নশাস্ত্রের দিকপাল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে। ফজলুল হকের প্রতি তাঁর ছিল আজন্ম পুত্রের ন্যায় স্নেহ-ভালোবাসা; একটি ঘটনার মধ্যে দিয়ে সুস্পষ্ট হয় বিষয়টি আমাদের কাছে: ‘১৯৩৮ সালের এপ্রিল মাসে হক মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আইন পরিষদে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করা হয়। অবশ্য অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এই প্রস্তাবের কথা শুনে স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় বললেন, আমি রাজনীতির কথা বলছি না। আমি বলছি বাঙালি জাতির ভবিষ্যতের কথা। সমস্ত রাজনৈতিক স্তরের ওপর আর একটা বড় সত্য আছে। সেটা বাঙালি জাতির অস্তিত্ব। বাঙালির ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব নির্ভর করে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের উপর। ফজলুল হক এই ঐক্যের প্রতীক।’ গণিত, পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন— এই তিন বিষয়ে একইসঙ্গে অনার্স নিয়ে স্নাতক হন ১৮৯৪ সালে। বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তখন একমাত্র তিনিই ছিলেন প্রথম এই ডিগ্রিধারী ব্যক্তি; পরের বছর গণিতে মাস্টার্স অর্জন করে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই। ১৮৯৭ সালে আইনের ডিগ্রি, বিএল পাশ শেষে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হয়ে কলকাতা হাইকোর্টে নাম নথিভুক্ত করেন এ কে ফজলুল হক এবং ১৯০০ সাল থেকে একজন উদীয়মান আইনজীবী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন অল্পদিনেই। পিতার মৃত্যুর সংবাদে পরের বছর কলকাতা থেকে বরিশাল ফিরে জেলা আদালতে আইনজীবীর ভূমিকায় প্রভূত খ্যাতির অধিকারী হন এবং বরিশাল বারের সহকারি সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯০৩-০৪ সালের জন্য।
বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে এ কে ফজলুল হকের অপূর্ব প্রতিভা ও কর্মদক্ষতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তৎসময়ের পূর্ববঙ্গ ও অসমের গভর্নর স্যার জোসেফ ফুলারের। গভর্নর নিজে ডেকে মর্যাদাপূর্ণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি দেন এ কে ফজলুল হককে। ঢাকা ও ময়মনসিংহে কিছুদিন চাকরি করার পর জামালপুর মহকুমায় এসডিও-এর পদে থাকাকালীন সময়ে দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করেন দক্ষতার সঙ্গে এবং অবসর সময়ে সাধারণ বেশে কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা, জমিদার-মহাজনদের অত্যাচার নিপীড়ন হয়রানি প্রত্যক্ষ করেন। পরবর্তী জীবনে তাঁর মধ্যে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে কৃষকদের মর্মযন্ত্রণা। এই অভিজ্ঞতায় সেদিনে তিনি শপথ নেন, জীবনে কখনও সুযোগ এলে দরিদ্র কৃষকদের ঋণমুক্ত এবং চক্রবৃদ্ধি সুদের ব্যবসা বন্ধ সহ জমিদারি প্রথা উৎখাত করবেন একদিন। এই সম্পর্কে তাঁর স্মরণ হয় ১৯০১ সালের একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা : তিনি বরিশাল থেকে চাখার যাওয়ার পথে খেয়া পার হয়ে রাস্তার পাশে কান্নাকাটি শুনে এক দরিদ্র কৃষকের বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, তাঁর ছোট ছেলে তার ছোট থালা ধরে কাঁদছে, সে কিছুতেই তার থালা পেয়াদাকে দেবে না। দেনার দায়ে কৃষকের সর্বস্ব নিলাম হয়েছে। ছেলেটির কান্নায় বাংলার সর্বহারা কৃষককূলের লক্ষ শিশুর কান্না শুনতে পেলেন ফজলুল হক। তিনি কৃষকের দেনার টাকা তখনই শোধ করে দিলেন। তার থালা ফেরত পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠল শিশুটির। ফজলুল হক প্রতিজ্ঞা করেন, যে প্রকারেই হোক তিনি বাংলার ঋণগ্রস্ত কৃষককূলকে ঋণমুক্ত করবেন। বরিশালের এই মর্মান্তিক ঘটনা তাঁর চিন্তাধারায় বিপ্লব সৃষ্টি করে।
ব্রিটিশ সরকারের চাকরিতে বেশি দিন মন বসাতে পারেননি তিনি, বিশেষত গ্রাম-বাংলার কৃষকদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখে। বিশ শতকের প্রথম দিকে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ, ১৯১৩ সালে ৩৯ বছর বয়সে প্রথম বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হন ঢাকা বিভাগ থেকে। রাজনীতিতে তাঁর আসার মূলত উদ্দেশ্য ছিল দুইটি— সমাজের অনগ্রসর অংশকে শিক্ষিত করে তোলা ও বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তি, তাদের জন্য মোটা ভাত-কাপড়ের সংস্থান করা। বাঙালির কাছে আজও দুই আদর্শের প্রতীক হয়ে আছেন শেরে বাংলা। কৃষকের কল্যাণে তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম ও প্রধান কাজ ছিল কৃষক-প্রজার ভাগ্যোন্নয়ন। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাসত্ত্ব সংশোধনী আইন পাসের মধ্য দিয়ে বাতিল করেছিলেন জমিদারদের নিপীড়নমূলক ক্ষমতার অপব্যবহার। প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন করে ‘শেরে বাংলা’ জমিদারদের কৃষক-প্রজা পীড়নের লাগামহীন ক্ষমতা চিরতরে বন্ধ করে দেন। ১৯৪১ সালে বন্ধক ও বাকি খাজনা আদায় সম্বন্ধে প্রজাদের সুবিধা দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালে তাঁর চেষ্টায় আইনের প্রথম সংশোধনী এনে ঋণ সালিশি বোর্ড গঠন করে কৃষকদেরকে ঋণমুক্ত করা হয়। ফ্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে তিনি বাংলার লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবারকে ঋণমুক্ত করার জন্য ১৯৪০ সালে মহাজনী আইন পাস করান। মহাজনী আইনে সুদের উচ্চ হার নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় এবং চক্রবৃদ্ধি সুদ বন্ধ করা হয়।’
উল্লেখ্য, উপমহাদেশে কৃষক সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা দূর করার জন্য ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট ছিল একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ। এই কমিশন বাংলার কৃষকদের অর্থনীতি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রিপোর্টে উল্লেখ করেন— ‘বাংলার কৃষক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, ঋণ করে বেঁচে থাকে এবং মৃত্যুর সময় ছেলেমেয়েদের জন্য রেখে যায় ঋণের বোঝা। কমিশনের মতে, কৃষকদের এই দুর্দশার কারণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা।’ ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্টে সারা ভারতের জমিদারি প্রথার মূলে কুঠারাঘাত করে— এই কথা। মুসলিম লিগ, জমিদার শ্রেণির, সর্বোপরি ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতার জন্য কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে ফজলুল হক জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের জন্য আইন প্রণয়ন করতে পারেননি, কারণ প্রাদেশিক আইনসভার তাঁর ক্ষমতা ছিল সীমিত। জমিদারি প্রথার সঙ্গে বাংলার মধ্যবিত্তের স্বার্থ ছিল এক সূত্রে গাঁথা এবং ব্রিটিশ রাজত্বেরও মূল ভিত্তি। নানা কারণে দেশ বিভাগের আগে জমিদারি উচ্ছেদ সম্ভব হয়নি। ১৯৫৪ সালে এ কে ফজলুল হক পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে জমিদারি উচ্ছেদের কাজ শুরু করেন এবং আওয়ামী লিগের সময় (১৯৫৬-৫৮) অধিকাংশ জমিদারি দখলের কাজ শেষ হয়। উল্লেখ্য, প্রথম জমিদারি উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছিলেন বরিশাল থেকে নিজের জমিদারির মাধ্যমে। জমিদার-তালুকদারদের শোষণ ও পীড়ন হতে যেমন লক্ষ লক্ষ কৃষক-প্রজা মুক্তির আস্বাদ পেল তেমনি জমির মালিকও হল।
১৯২৯ সালে ফজলুল হক প্রবর্তিত কৃষক-প্রজাদের রাজনৈতিক পার্টিই (নিখিল বঙ্গ কৃষক-প্রজা সমিতি) প্রথম চেয়েছিল বিনা ক্ষতি পূরণে জমিদারি প্রথার অবসান ও কৃষকদের মুক্তি। মুসলিম লিগের নেতৃত্ব পদে সেই সময়ে তিনি থাকলেও তার সমস্ত শক্তি ব্যয় করতেন কৃষক-প্রজা সমিতির কাজেই। প্রজার স্বার্থের সঙ্গে তিনি কৃষকের স্বার্থ যুক্ত করেছিলেন এই রাজনৈতিক দলের। বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ড হচ্ছে কৃষক সম্প্রদায় এবং তারা দেশের সংখ্যাগুরু অংশ — এই কথা ভালো করে জানতেন এ কে ফজলুল হক। তাই তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেছিলেন কৃষকের উন্নতি না হলে দেশেরও উন্নয়ন সম্ভব নয় কখনও ।
উপমহাদেশে সমবায় আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ এ কে ফজলুল হক। সমবায় আন্দোলনই বাংলার অসংখ্য কৃষকের ভাগ্য বদলে দিতে পারে বলে তাঁর বিশ্বাস ছিল দৃঢ়। কৃষক সমাজ মহাজনদের শোষণের হাত থেকে রক্ষা পাবে সমবায় শক্তিশালী হলে। সমবায় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞানার্জনের জন্য ফজলুল হক ১৯০৮ সালে এসডিও’র পদের মোহ ত্যাগ করে সমবায় বিভাগের সহকারী নিবন্ধকের চাকরি গ্রহণ করেন এবং ওই পদে কাজ করেন ১৯১১ সাল পর্যন্ত; এখানেই শেষ করে দেন চাকরি জীবনের। সমবায় আইন পাস হয় ১৯৪০ সালে ও সমবায় বিধি প্রণয়ন হয় ১৯৪২ সালে তাঁর শাসনামলে। কৃষকের উপর জমিদার-মহাজনদের নিপীড়ন চিরতরে বন্ধ ও ডাল-ভাতের সংস্থান করার উদ্দেশ্যে ১৯১৪ সালে প্রথম প্রজা আন্দোলন শুরু করেন এবং বিভিন্ন জেলায় প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কৃষকের দুঃখ-দুর্দশা ও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে শুধু যে, তিনি আন্দোলন করে গেছেন— তাই-ই নয় তাদের সম্পর্কে নিয়মিত বিভিন্ন খবরাখবর যাতে আম-জনতার দৃষ্টিগোচর হয় এজন্য প্রকাশ করেন কৃষক সমাজের মুখপত্র ‘দৈনিক নবযুগ’ (১৯১৯) নামের একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা; সম্পাদনায় ছিলেন কমরেড মুজাফফর আহমদ ও কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পরবর্তীতে ১৯৩৮ সালে এ কে ফজলুল হকের অনুপ্রেরণায় কৃষক-প্রজা সমিতি প্রকাশ করে ‘কৃষক’ পত্রিকা; পত্রিকার প্রধান পরিচালক ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির সম্পাদক শামসুদ্দিন আহমেদ ও সম্পাদনায় আবুল মনসুর আহমেদ। বিশেষত আর্থিক অসুবিধার কারণে পত্রিকা দুইটি বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি। সারা দেশে প্রজা সমিতি একটি সামাজিক সংগঠন হিসেবে প্রভাব বিস্তার করে ১৯৩০সালের মধ্যে। ‘ঢাকায় ১৯৩৬ সালের ১১,১২ জুলাই নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির ৪র্থ সম্মেলনে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক সভাপতির ভাষণে বলেন, চিরস্থায়ী জমিদারি প্রথা, ঋণ সমস্যা, কৃষক আন্দোলন ও সাম্প্রদায়িকতা, সালিশি বোর্ডের উপকারিতা, উন্নত ধরনের চাষ দ্বারা আয় বৃদ্ধির উপায়, খাজনা সমস্যা, নতুন শাসন সংস্কার আইন, ইউনাইটেড মুসলিম দল ও প্রজা সমিতি প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি জমিদারি প্রথাকে মনুষ্যত্বের অপচয়কারী বলে আখ্যা দিয়ে বলেন, এই ব্যবস্থা যত সত্বর বিলোপ হবে, দেশের জন্য ততই মঙ্গল।’
গ্রাম-বাংলার মানুষের মনে কৃষক-প্রজা সম্পর্কে ব্যাপক সাড়া জাগানোর কারণে নিজের অবস্থান ও রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এ কে ফজলুল হক। মুসলিম লিগ নেতৃত্ব যেমন কোনও সময় সাধারণ কৃষকের অবস্থা অনুধাবন করার চেষ্টা করেনি তেমনি কংগ্রেসও চেষ্টা করেনি কৃষকের মৌলিক সমস্যাগুলির সমাধানের। এমনকি তাঁর মতো বলিষ্ঠ কণ্ঠে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপের জন্যও কেউ জনসমক্ষে দাবি তুলে ধরেননি।
১৯৪৩ সালের পর বাঙালির প্রাণপ্রিয় মহান নেতা শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক ষড়যন্ত্রের ফলে সরে যান রাজনীতি থেকে; দেশ ভাগের অন্তত সাত/আট বছর পর ১৯৫৪ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতির অঙ্গনে উল্কার মতো আগমন ঘটে তাঁর। যেভাবে সেদিন জনগণ তাঁকে বরণ করে নিয়েছিলেন— তাতে প্রমাণ হয় তাঁর আসন স্থায়ী হয়ে আছে সবার অন্তরে; তিনি মোটেও ফুরিয়ে যাওয়ার নন। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক মানুষের কাছে কি পরিমান জনপ্রিয় ছিলেন সেটাও প্রমাণ হয় ঢাকায় ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল তাঁর মৃত্যুর সময়; দেশে সামরিক শাসনকে উপেক্ষা করে সারা দেশের মানুষের আহাজারি ও সেদিনে প্রমাণ করেছিল মরণের পরেও তিনি বাংলার সবচেয়ে প্রাণপ্রিয় নেতা।
শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকই প্রথম কৃষক ও নির্বিশেষে সকল প্রজার জন্য অন্তত পক্ষে দু’বেলা ডাল-ভাতের ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করেন গ্রাম-বাংলার মাঠে-ঘাটে। বাংলার আর কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিই তার আগে কৃষকদের ব্যাপকভাবে রাজনীতির ময়দানে টেনে আনতে সক্ষম হননি; কৃষকদের মধ্যে সামাজিক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন একমাত্র তিনি। জনগণের মধ্যে থেকে তিনি রাজনীতি করতে ভালবাসতেন সর্বদা; আত্মবিস্মৃত একটি জাতির ঘুম ভাঙানিয়ার কাজ করেছেন সারাটা জীবন ধরে। দুর্গত, নিপীড়িত ও মানবতার জন্য সংগ্রাম জারি রেখেছিলেন আমৃত্যু। তাঁর শাসনামলে ব্রিটিশ ভারতে সীমিত ক্ষমতায় যেসব আইনগত সংস্কারের ব্যবস্থা করেছিলেন— তা ভারতের ইতিহাসে ছিল বিরল ঘটনা।