বিশেষ প্রতিবেদক: সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক চললে বাংলার সবথেকে গভীর সমুদ্রবন্দর হতে চলেছে তাজপুর। সেক্ষেত্রে খিদিরপুর, হলদিয়া বন্দরকে টেক্কা দিতে চলেছে পূর্ব মেদিনীপুরের তাজপুর বন্দর। আসলে তাজপুরে গভীর সমুদ্র বন্ধর গড়তে প্রস্তাব দিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী।
তাদের সেই আবেদনে সাড়া দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সরকার।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, তাজপুরে গভীর সমুদ্রবন্দর হলে পূর্ব-ভারতের এই বন্দর কি হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের অন্যতম কেন্দ্র?
বিশেষজ্ঞদের মতে, তাজপুরে বন্দর হলে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা আরও মসৃণ হয়ে উঠবে।
তাজপুরে সমুদ্রবন্দর গড়তে শীঘ্রই ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল মেরিটাইম বোর্ড’ অনুমতিপত্র তুলে দেবে ‘আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন’ (এপিএসইজেড)-এর হাতে।
তাজপুর বন্দর নির্মাণে বিনিয়োগ হতে পারে ২৫ হাজার কোটি টাকা। এজন্য যে টেন্ডার বা দরপত্র ডাকা হয়েছিল তাতে অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিল, তবে এপিএসইজেড-ই সর্বোচ্চ দর দিয়েছে।
এখন এপিএসইজেডের হাতে রাজ্য সরকার সম্মতিপত্র তুলে দিলেই শুরু হবে তাজপুরে সমুদ্রবন্দর তৈরির কাজ। এই পত্রের সঙ্গেই হবে আদানি পোর্টের সঙ্গে চুক্তি। ফলে বলা যায় কলকাতা বন্দরের তাজপুর হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের গভীরতম সমুদ্রবন্দর।
তাজপুর হবে বাংলার প্রথম গ্রিনফিল্ড বন্দর। গত অর্ধশতকে যা হয়নি। সাধারণত গ্রিনফিল্ড প্রকল্পে নির্মাণকাজ হয় অব্যবহৃত জমিতে, যাতে কোনও রকম স্থায়ী নির্মাণকে ভাঙতে বা বদল করতে না হয়। কলকাতা বন্দরের মতো বড় বন্দরের পাশাপাশি এই রাজ্যে অনেক ছোট বন্দরও রয়েছে। তথ্য বচষে ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষে কলকাতা বন্দর (খিদিরপুর) সামলেছে ৬১.৩৬ মিলিয়ন টন কার্গো ট্রাফিক।
এই বন্দর ভারতের ১২টি বড় বন্দরের মধ্যে পঞ্চম। এই সময়কালে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভেসেল সামলেছে এই বন্দর। কলকাতা বন্দরের পাশাপাশি পূর্বাঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ বন্দর হল ওড়িশার পারাদ্বীপ বন্দর।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও মেরিটাইম ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের মতে, তাজপুর গভীর সমুদ্রবন্দর শুধু এই রাজ্যের সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করবে না, সেই সঙ্গে গোটা পূর্বাঞ্চলের সামুদ্রিক প্রবেশদ্বার হয়ে উঠবে।
নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, ‘‘তাজপুর বন্দরের মাধ্যমে বাংলায় উন্নয়নের জোয়ার আসবে। তিনি আরও বলেন, ‘এটা বাংলার জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। বাংলায় বিপুল কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং অগ্রগতির ঢেউ আসবে। মুখ্যমন্ত্রী শীঘ্র একটি বৈঠকের আয়োজন করে সম্মতিপত্র তুলে দেবেন। আমরা বাংলায় প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর দেখতে পাব।’’
উল্লেখ্য, এর আগে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হলদিয়া ডক কমপ্লেক্সের উন্নয়নে সর্বোচ্চ দর আহ্বায়ক হিসেবে উঠে এসেছিল এপিএসইজেড। কিন্তু কলকাতা বন্দর কর্তৃপক্ষ তাদের হাতে এখনও চুক্তিপত্র তুলে দেয়নি বলে জানা গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তাজপুরে যেখানে এই বন্দরটি গড়ে উঠবে কলকাতা থেকে তার দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি।
বর্তমানে যে সংস্কার সাধনের কাজ চলছে তা সম্পূর্ণ হলে এখানে বৃহত্তম কার্গো ভেসেল আনা যাবে। মেরিটাইম বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটা একটা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার।
কারণ, বৃহত্তর জাহাজ এই রাজ্যের বন্দরগুলিতে আনা যায় না। তাজপুর বন্দরে থাকবে ১২.১ মিটার গভীর ড্রাফট (জলতল) ও ১৮ কিলোমিটার চ্যানেল। ক্রিসিল মার্কেট ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড অ্যানালিটিক্সের অধিকর্তা জগন্নারায়ণ পদ্মনাভন বলেছেন, বন্দরের পাশাপাশি প্রায় ১ হাজার একর জমি আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া হবে।
এই জমি দেওয়া হচ্ছে শিল্প-কারখানা ও বন্দর-চালিত উন্নয়নের জন্য। বিনিয়োগের পরিমাণও বিপুল।’ তিনি এরই সঙ্গে যোগ করেছেন, উপকূলীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা পালন করবে এই বন্দর। তাঁর মতে, ‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিমবঙ্গ থেকে যদি আপনি চেন্নাই, কেরল বা মহারাষ্ট্রে যেতে চান তাহলে আপনার এখন একটা অতিরিক্ত পথ থাকছে। পঞ্জাবের অমৃতসর থেকে পশ্চিমবঙ্গের ডানকুনি হয়ে এক উন্নয়নের পরিসর সৃষ্টি করতে পারে এটি। তাজপুর বন্দর হয়ে গেলে, ডানকুনির সঙ্গে কলকাতার সংযোগ নিয়ে আরও ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ তৈরি হবে।’ ওয়াকিফহাল মহলের মতে, তাজপুর বন্দরের কাজ সম্পন্ন হয়ে গেলে বাংলার অর্থনৈতিক মানচিত্র অনেকখানি বদলে যাবে।