বিপাশা চক্রবর্তী, কলকাতা: যেসমস্ত কিংবদন্তি ভারতকে এক অনন্য গৌরব এনে দিতে পেরেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ব্যক্তিত্ব ভি বালসারা। ২২ জুন, ২০২২ তাঁর জন্মশতবর্ষ। সুরের জাদুকর ভারতীয় সংগীতের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ভিয়েস্তাপ আদের্শির বালসারা। সকলের কাছে জনপ্রিয় ভি বালসারা নামেই।
মুম্বইয়ের এক গুজরাতিভাষী পারসি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ছোট থেকেই ছিল সংগীতের প্রতি অদম্য ভালোবাসা। জীবনের শুরুতে সংগীতের প্রথম শিক্ষাগুরু ছিলেন তাঁর মা। শিখিয়েছিলেন হারমোনিয়াম বাজাতে। মাত্র ছয় বছর বয়সে পেডাল হারমোনিয়াম বাজিয়েছিলেন মুম্বইয়ের (তৎকালীন বোম্বাই) সিজে প্রেক্ষাগৃহে। পরবর্তী সময়ে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা কারোর অজানা নয়। পিয়ানো-সহ পাঁচটি বাদ্যযন্ত্রের উপর অনায়াস যাতায়াত ছিল তাঁর। তালিম নিয়েছিলেন জার্মান সংগীতশিল্পী হিলডা ফিল্ডের কাছেও।
১৯৫৩ সালে বাংলা সংগীতের সুপরিচিত ও পণ্ডিত সংগীতজ্ঞ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বালসারাকে কলকাতায় একটি সংগীত সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেই শুরু তাঁর কলকাতার প্রতি ভালোবাসা। ধীরে ধীরে কলকাতারই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে পড়েন তিনি। জড়িয়ে পড়লেন বাংলা চলচ্চিত্র এবং বাংলা গানের সঙ্গে। রবীন্দ্র সংগীতের প্রতি তাঁর ছিল গভীর প্রেম। বাংলায় বিভিন্ন চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্কেস্ট্রা কন্ডাক্টর, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ডিরেক্টর, সহকারী সংগীত পরিচালক এবং স্বাধীন সংগীত পরিচালকের ভূমিকা পালন করতে থাকেন। ‘দেশিকোত্তম সম্মানে’ ভূষিত হন তিনি। বাংলা হিন্দি মিলিয়ে চল্লিশের বেশি ছায়াছবিতে সংগীত পরিচালনা করেছিলেন। আশি জন মিউজিশিয়ান নিয়ে নিবেদন করেন ‘দেবতার গ্রাস’।
সুরের এই জাদুকর ছাত্রছাত্রীদের কাছে ছিলেন ‘দাদা’। সেই দাদাকে (ভি বালসারা) শ্রদ্ধা জানালেন তাঁর অন্যতম সুযোগ্য ছাত্রী, ‘মিউজিক ফিঙ্গারস’-এর কর্ণধার শাঁওলী সেন।
শাঁওলীদেবীর কথায়, দাদা এক অনন্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ভাষায় বলে প্রকাশ করা যাবে না। একাধারে একজন শিক্ষক, অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ভীষণ ভালো একজন বন্ধু ছিলেন। সেই অল্পবয়সে যে কথা বাবা-মাকে বলতে ভয় পেতাম, দাদাকে বলতে পারতাম অনায়াসেই। কোনওদিন শিক্ষক হিসেবে নিজের থেকে শিক্ষার্থীদের দূরত্বে সরিয়ে রাখেননি। ভালোবাসাও যেমন পেয়েছি, তেমনি সুরের একটু এদিক-ওদিক হলেই বকুনি।
ভীষণভাবে চাইতেন, মেয়েরা কিছু করুক, সমাজে কিছু করে দেখাক। সেই সময়ে মেয়েদের কোনও সাফল্যের কাহিনি কাগজে প্রকাশিত হলেই তার একটা পেপার কাটিং আমার জন্য আলাদা করে সরিয়ে রাখতেন। পরে ক্লাসে গেলে বলতেন, ‘দ্যাখ এই মেয়েটা কী রকম করে দেখাল’। সেই কথা আমার আরও জেদ বাড়িয়ে দিত, আমি আমার সমস্তটা দিয়ে ওঁনার থেকে আরও বেশি করে শেখার চেষ্টা করতাম। আজ যতটুকু হতে পেরেছি, সব কৃতিত্ব দাদার। মায়ের হাত ধরে দাদার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু দাদা আমার জীবনে অন্যতম অনুপ্রেরণা। লড়াই করে কীভাবে উঠে দাঁড়াতে হয়, নিয়মানুবর্তিতা, কাজের প্রতি দায়িত্ব, আনুগত্য, ভালোবাসা সব ওঁনার (ভি বালসারা) কাছ থেকে পাওয়া। যেকোনও অনুষ্ঠানে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই পৌঁছে যেতেন তিনি। মাঝে মধ্যে মজা করে বলতেন, ‘আমার মতো পাংচুয়াল হোস না, কদর পাবি না।’
শাঁওলীদেবী বলেন, ১১ বছর বয়সে তাঁর বড় ছেলে ব্রঙ্কোনিউমিয়ায় মারা যান, সিরোসিস অফ লিভারে আক্রান্ত হয়ে ছোট ছেলের মৃত্যু হয় মাত্র ৪৫ বছর বয়সে। স্ত্রী গত হন। কিন্তু কোনওদিন কাজ থামাননি তিনি। স্ত্রী যেদিন মারা যান, সেদিনও স্টেজে বাজিয়েছিলেন দাদা। সব সময় আমাকে বলতেন, কাজ সবথেকে বড়। সব কিছুর থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে শিখিয়েছিলেন কাজকে। নিজেও তাই দিতেন। স্ত্রী মারা যাওয়ার দিনও দাদা স্টেজে বাজিয়েছিলেন ‘পুরানো সেই দিনের কথা’। পরে আমাদের বলেছিলেন, আজ এই গানটির মধ্যে দিয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি পেলাম, আগে কখনও হয়নি।
দাদার সবথেকে প্রিয় গান ছিল ‘বড় আশা করে এসেছি গো কাছে ডেকে নাও’, ‘আগুনের পরশমণি’, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’।
‘মিউজিক ফিঙ্গারস’-এর কর্ণধার শাঁওলী সেন জানালেন, তাঁর বাড়িতে আমাদের প্রশিক্ষণ শুরু হওয়ার আগে একটা অদ্ভুত জিনিস লক্ষ্য করতাম। দেখতাম, দেওয়ালে লাগানো আছে সব ধর্মের দেবদেবীর সঙ্গে যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের ছবি। মা সারদা, মহানায়ক উত্তম কুমার থেকে আরও অনেকের ছবি। ছিল তার প্রয়াত ছেলের ও আমার মায়ের ছবিও। ক্লাস শুরুর আগে দেখতাম সেই ছবিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করতে। একদিন জিজ্ঞাসা করি, দাদা ছবিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে কী বলো তুমি? বলছিলেন, কোনও মন্ত্রপাঠ করি না, একটা গান গাই। সেটা হল ‘বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে নাও’। তার পরেই একটা ডায়েরি নিয়ে বসতেন। সেখানে কোনও ছাত্রছাত্রীর কবে জন্মদিন সেটা লিখে রাখতেন। সেই তারিখ অনুযায়ী তাদের শুভেচ্ছা জানাতেন। এ সবই তাঁর কাছ থেকে শেখা। অনেক বড় মাপের একজন শিল্পী ছিলেন। তখন অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না।
আমার মা দাদার গ্রুপে গান গাইতেন। তার পর মায়ের সঙ্গেই আমি একদিন ওখানে যাই। আমিও ছোটবেলায় ব্রঙ্কোনিউমিয়ায় ভুগতাম। বড় ছেলেকে এই অসুখে হারিয়েছিলেন দাদা। আমাকে দেখে মাকে বলেছিলেন, এই মেয়েটাকে আমার কাছে দিয়ে দাও। তালিম দেব। আমার যত্ন নিয়ে পরামর্শ দিয়ে মাকে তিন পাতার চিঠিও লেখেন তিনি। আমাকে দেখে হয়তো তাঁর সেই সন্তানস্নেহ জেগে ওঠে। তার পর থেকে প্রায় দীর্ঘ বছর দাদার কাছ থেকে তালিম নেওয়া। এর জন্য আমার কাছ থেকে কোনও পারিশ্রমিক নেননি কোনওদিন।
মাঝে মধ্যে মনে হয়, এত বড় মাপের একজন শিল্পীর আরও অনেক অনেক কদর পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দাদার এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ ছিল না। সব সময় বলতেন যা চেয়েছি, তার থেকে অনেক অনেক বেশি পেয়েছি। দিনের বেশিরভাগ সময় কঠোর অনুশীলন করতেন। জীবনের শেষদিকে খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
শাঁওলী জানান, তখন ১৫ বা ১৬ বছর বয়স হবে আমার প্রথম স্টেজ পারফরম্যান্স। স্টেজে উঠে সামনে দেখি চারিদিক পুরো অন্ধকার। গিরিশ মঞ্চে উমেনস কলেজের সমাবর্তনী অনুষ্ঠানে প্রথম স্টেজ শো ছিল আমার। পরে প্রোগ্রাম শেষে দেখি একটা হাত আমার পিঠে এসে লাগল। পরে বুঝি ওটা দাদার হাত ছিল। ওইদিন অনুষ্ঠানের পর প্রচুর মানুষ আমাকে ঘিরে ভিড় করে অটোগ্রাফ নিচ্ছিলেন। খুব খুশি হয়েছিলেন দাদা। একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘আগুনের পরশমণি’ গানটা বাজাতে। তারপর বলেছিলেন, ‘তুই আমার থেকেও ভালো বাজিয়েছিস’। সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
শাঁওলী বলেন, মাঝে মধ্যে বকাঝকা করলে রাগ করে বাড়ি চলে আসতাম। আবার বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাগ ভাঙাতেন। ঠিকমতো সুর না বাজালে পাশে ঝুল ঝাড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখন খুব কম বয়স, তাই রাগও একটু বেশি ছিল আমার। অতকিছু বুঝতাম না। একদিন রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করি, সবসময় আমার ওপর এত রাগারাগি করো কেন? বলেছিলেন, ‘আমি জানি তোর মধ্যে সেই প্রতিভা আছে, তুই পারবি, তাই সেগুলোকে একটু নাড়িয়ে দিই।’
দাদা ভীষণভাবে রবীন্দ্রসংগীতের ভক্ত ছিলেন। সেইসঙ্গে ছিল তাঁর নতুনকে গ্রহণ করার ক্ষমতা। আমাকে বলতেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো মর্ডান কম্পোজার আর কেউ নেই। স্বরবিতান পড়বি। তাহলে কোনও সুর তুলতেই অসুবিধা হবে না। সেইসময় ভূমির ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ গানটি সকলের মুখে মুখে। দাদাকে দেখলাম, একটি স্টেজ শোতে সেই গানের সুর বাজাতে। খুব রাগ করেছিলাম। কিন্তু দাদা বলেছিলেন, এর মধ্যে তো কিছু খারাপ নেই। নতুনকে সবসময় জায়গা করে দিতে হয়।
খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন, কিন্তু ছিলেন খুব প্র্যাকটিক্যাল। বলেছিলেন, কারোর কাছ থেকে কোনওদিন কিছু আশা করবি না, নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে সংগীতের মধ্যে সঁপে দে।
নিজের ছাত্রছাত্রীদের তো বটেই, নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে অসম্ভব খুঁতখুঁতে একটা মানুষ ছিলেন। স্টেজে উঠে আলো জ্বালিয়ে দিতে বলতেন। বুঝতে চাইতেন দর্শকদের অভিব্যক্তি।
পার্সি হলেও ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন বাঙালি। ফুচকা, ঝালমুড়ি, ভেলপুরি ছিল প্রিয় জিনিস। আর পছন্দের তালিকায় ছিল সরষে ইলিশ। আমার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করলেই, আগে জিজ্ঞাসা করতেন মেন্যুতে সর্ষে ইলিশ আছে কি না? আর ভালোবাসতেন কাজুবরফি খেতে। তাঁর প্রয়াণের পর আমি কাজুবরফি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
দাদা নেই এখনও ভাবতে পারি না। মনে করি আজও প্রতি পদক্ষেপে উনি সবসময় একজন শিক্ষক, অভিভাবক, বন্ধু হিসেবে আমার পাশেই আছেন।