কিবরিয়া আনসারী: সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক হয়েছে রেল পরিষেবা। কিন্তু দেশের সব প্রান্তের মানুষ কি সেই সুবিধা পাচ্ছেন? রেল পরিষেবা থেকে বঞ্চিত মুর্শিদাবাদের ডোমকল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা। এই এলাকায় রেল যোগাযোগ গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিনের। এবার লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে রেল যোগাযোগের জোরালো দাবি উঠতে শুরু করেছে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন এলাকায়। ডোমকল মহকুমা সহ পাশ্ববর্তী করিমপুরের বাসিন্দাদের দাবি, দীর্ঘদিন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত এলাকায় রেল সংযোগ করা হোক।
ভারতীয় রেলকে দেশের ধমনিস্বরূপ বলা হয়। কারণ, স্বল্প খরচে অতি দ্রুত মানুষ এবং পণ্যকে এক শহর থেকে অন্য শহরে পৌঁছে দেয়। যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গ্রাম থেকে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ রেলপথে শহর ও নগরে যাতায়েত করেন। কিন্তু স্বাধীনতার এতগুলো বছর পার করার পরও বিস্তীর্ণ এই অঞ্চলে রেল যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে করিমপুর-জলঙ্গি-ডোমকল-ইসলামপুর-দৌলতাবাদ হয়ে বহরমপুরে রেল যোগাযোগ গড়ে উঠলে লক্ষ লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলবে বলে মনে করছে দুই জেলার বহু মানুষ। কয়েকমাস আগেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়ে রেলপথের দাবিতে জোরালো আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন বহু মানুষ। ভারতীয় রেলকে এই অঞ্চলের জন্য রেল সংযোগের দাবি পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে আলোচনাও শুরু করেছেন তারা। এই দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে অনেকেই বলছেন, “এই রেললাইনটা হওয়া জরুরী।”
জেলার উপর দিয়ে পূর্ব রেলের দু’টি শাখার রেল লাইন গেলেও ডোমকলের উপর দিয়ে কোনও রেল লাইন তৈরি হয়নি। এর আগে অনেকেই রেল লাইনের দাবি তুলেছিলেন। তবে তা পূরণ হয়নি। রেল যোগাযোগ থেকে ব্রাত্যু রাখা হয়েছে লক্ষ লক্ষ মানুষকে। জেলার সদস শহর বহরমপুর যেতে ডোমকলের মানুষের একমাত্র ভরসা বাস। অন্যদিকে, কলকাতা যাওয়ার ক্ষেত্রে ডোমকল মহকুমা এলাকার বাসিন্দাদের ট্রেন ধরার জন্য লালগোলা-শিয়ালদহ শাখার বহরমপুর কিংবা মুর্শিদাবাদ স্টেশন যেতে হয়। অনেকেই খাগড়াঘাট রোড হয়ে কলকাতা শহরে যান। করিমপুরের বাসিন্দাদের ক্ষেত্রে যেতে হয় কৃষ্ণনগর স্টেশন। এই অঞ্চলের বহু মানুষ নিত্যদিন ব্যবসায়িক, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রয়োজনে বহরমপুর এবং কলকাতা যান। ডোমকলের ওয়াসিম হায়দার, তামিম আক্তার, আলবিরুনি মন্ডল, সোহানা পারভিন ও সাকিলা খাতুনদের কথায়, ‘কলেজে ছুটি পেলে বা প্রয়োজনে কলকাতা থেকে বাড়ি যেতে হলে অন্তত ৬-৭ ঘন্টা সময় নিয়ে বেরোতে হয়। বেশি রাত্রি হলে গাড়ি পেতে সমস্যা হয়। এই অঞ্চলে রেল যোগাযোগ তৈরি হলে আমাদের সুবিধাই হবে।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য গ্রাম থেকে কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যান বহু মানুষ। আর্থিক অস্বচ্ছতার কারণে দিনের দিন গিয়ে ফের চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাদের। এক্ষেতে অনেক শারীরিক ধকল পোহাতে হয়। মাসে কম করে একবার কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যান আফরোজা, রুবিয়া, রোকেয়া বিবিরা। তাদের বক্তব্য, ‘জানিনা কবে এই দূর্ভোগ কমবে। এই রেললাইনটা হওয়া জরুরী।’ জলঙ্গির এক বাসিন্দার কথায়, “জলঙ্গি থেকে বহরমপুর রেল স্টেশনের দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। কলকাতা বা অন্যত্র যেতে ট্রেন ধরতে হলে এই দীর্ঘ পথ পেরতে হয়। সড়কপথে কলকাতা যেতে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। সমস্যা বেশি কলকাতায় চিকিৎসা করাতে যাওয়া রোগী ও তাঁদের আত্মীয়দের। এই অঞ্চলে রেলপথ চালু হলে কয়েক লক্ষ মানুষ উপকৃত হবেন। আমরা চাই দ্রুত এটা চালু হোক।”
বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, ভোট আসলেই শুধু প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি মেলে। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলের মানুষের জন্য কেউ রেলপথের দাবি জানাননি। ডোমকলের আব্দুল গনি ও মতিউর রহমানের দাবি, “এই অঞ্চলের মানুষের কথা ভাবেন না বলেই মুর্শিদাবাদের কোনও সাংসদ কখনোই লোকসভায় এই অঞ্চলের মানুষের সুযোগ সুবিধার কথা চিন্তা করে রেলপথের দাবি তোলেননি। তবে এই এলাকায় রেলপথ হলে বহু মানুষের জীবনযাত্রার আমুল পরিবর্তন ঘটবে। অবিলম্বে কৃষ্ণনগর হয়ে করিমপুর-জলঙ্গি-ডোমকল হয়ে বহরমপুর নতুন রেলপথ তৈরি নিয়ে ভাবা হোক। এলাকার জনপ্রতিনিধিদের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে অনুরোধ করছি।”
স্বাধীনতার পর থেকেই এই দীর্ঘ রুটে রেল চেয়ে আসছে ইসলামপুর- ডোমকল-জলঙ্গি-করিমপুর-তেহট্টের প্রায় ২৫ লক্ষ মানুষ। সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত এই এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নতির জন্য রেল যোগাযোগ আশু প্রয়োজন। করিমপুরের শিক্ষক ও সমাজকর্মী রেবাউল মন্ডল বলেন, “আমরাও সেই ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি, রেলপথ হবে। আমাদের বাপ-ঠাকুরদাও এই একই কথা শুনে শুনে ইহলোক ত্যাগ করেছেন। রেলপথ হলে কৃষি সহ শিক্ষা,স্বাস্থ্য ও শিল্পের দিগন্ত খুলে যাবে। ভোট এসেছে গেছে। কিন্তু মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি কেউই।” তাঁর দাবি, তবে রেল না হওয়া পর্যন্ত আপাতত এই দীর্ঘ রুটে পর্যাপ্ত এসি, নন এসি সরকারি বাস পরিষেবা চালু করা হোক। তাতে বেসরকারি গাড়ির দ্বিগুন ভাড়া থেকে রক্ষা পাবে সাধারণ মানুষ।