দেবিকা মজুমদার: ৬০ বছর আগে কলকাতার বুকে নিজের মূক-বধির মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর জন্য হিমশিম খাচ্ছিলেন পারসি কমিউনিটির মিসেস ডোরাব এডেনওয়ালা। সে সময় কলকাতায় মূক-বধিরদের জন্য কোনও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল না থাকায় এডেনওয়ালা পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। সেখানে মূক-বধিরদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের উপায় নিজে শিখে কলকাতায় ফিরে তৈরি করেন ‘দি ওরাল স্কুল ডেফ চিলড্রেন’। ১৯৬৪ সাল থেকে ৪-বি শর্ট স্ট্রিটে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের বিপরীতে ধুন এবং ডোরাব এডেনওয়ালার হাতে তৈরি এই স্কুলে প্রথমে পড়ুয়া ছিল মাত্র তিনজন। আর আজ, এই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৫০।
তবে, পড়ুয়াদের সংখ্যা বাড়ানোর দিকে নয়, স্কুল কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য পড়ুয়াদের স্বনির্ভর করে তোলা। তাই, এক একটি ক্লাসে সর্বোচ্চ পাঁচজন পড়ুয়া ও একজন শিক্ষক বা, শিক্ষিকা থাকেন।
সম্প্রতি এই বিশেষ স্কুল পরিদর্শন করতে যান মাইনরিটি কমিশনের চেয়ারম্যান ও পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক আহমদ হাসান ইমরান। ছাত্র-ছাত্রী এবংস্কুল কর্তৃপক্ষ জনাব ইমরান ও সহযোগীদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। বিশেষভাবে সক্ষম স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজেদের হাতে তৈরি কিছু ছবি ও অন্য উপহার জনাব ইমরান ও তাঁর সহযোগীদের হাতে তুলে দেয়। সংখ্যালঘু কমিশনের চেয়ারম্যান জনাব ইমরান এবং জনাব মুস্তাফিজ হাসমি চকলেট বাক্স প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীদের উপহার দেন।
কলকাতার ঝাঁ চকচকে বহুতলের মাঝে প্রায় ঢাকা পড়ে যাওয়া এই স্কুলে কলকাতার ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, বড়বাজার, শ্যামবাজার, তোপসিয়া, কাঁকুড়গাছি, পার্কস্ট্রীট, গড়িয়া থেকে তো বটেই পড়ুয়ারা পড়তে আসে হাওড়া, বজবজ, চুঁচুড়া থেকেও। এর কারণ বোধহয় বিশেষভাবে সক্ষম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য এখনও কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে খুব বেশি মানসম্পন্ন স্কুল নেই। শুধু এ রাজ্যে কেন সারা ভারতেও বোধহয় এই ধরনের শিক্ষাকেন্দ্রের ব্যাপক অভাব রয়েছে।
স্কুলের বরিষ্ঠ শিক্ষক বাহাদুর পোস্টওয়ালা জানান, এই স্কুলে মোট আটটি ক্লাস আছে। ওয়ান, টু, থ্রি, ফোর হিসেবে নয়, এখানে নার্সারি, প্রি-প্রাইমারি, প্রাইমারি, জুনিয়র এ, জুনিয়র বি, জুনিয়র সি, সিনিয়র সেকশানে ভাগ করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়। এক একটি ক্লাসে মোটামুটি দু-বছর করে পড়ে পড়ুয়ারা। প্রতিটি ক্লাসে পাঁচজন করে পড়ুয়া রাখা হয়। ‘দি ওরাল স্কুল ফর ডেফ চিলড্রেন’-এ ছাত্রছাত্রীদের কম্পিউটার শিক্ষার উপরও জোর দেওয়া হয়।
শুধু তাই নয়, পড়ুয়াদের স্কুলের মাইনে এবং হিয়ারিং এইড-এর ক্ষেত্রে ভর্তুকিও দেওয়া হয়। বাহাদুর পোস্টওয়ালা জানান, এই স্কুলের মাসিক মাইনে পাঁচ হাজার। এই ধরনের অনেক স্কুলে অবশ্য মাইনে আরও বেশি। যদি দি ওরাল স্কুল ফর ডেফ চিলড্রেন-এর কোনও শিক্ষার্থীর বাবা-মা স্কুলের মাইনে দিতে সক্ষম না হন, তাহলে তিনি যতটা দিতে পারবেন তাকেই স্কুলের মাইনে হিসেবে গ্রহণ করা হয়। ঠিক সেভাবেই হিয়ারিং এইড মেশিন কেনার ক্ষেত্রেও ছাত্রছাত্রীদের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে বিশেষ ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
প্রায় ১৭ বছর ধরে এই স্কুলের সঙ্গে যুক্ত অপর এক শিক্ষিকা সুপ্তা গণেশ জানান,স্কুলের পড়ুয়াদের শিক্ষা গ্রহণের সুবিধার্থে একধরণের মাইক্রো মাইক ব্যবহার করা হয়, যেটা চার্জ করে রাখতে হয় এবং এটি আশাপাশের আওয়াজ বাদ দিয়ে শিক্ষক বা শিক্ষিকার আওয়াজ ছাত্র-ছাত্রীদের কানে পৌঁছে দিতে সহায়তা করে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-ছাত্রীরা নিওস (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ওপেন স্কুলিং) থেকে তাদের ডিগ্রি পেয়ে থাকে। তবে, পড়াশোনার পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের আঁকা, নাচ, মূকাভিনয় শেখানো হয়। তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন কারিগরি বিক্রি করা হয় প্রতি বছর অগাস্ট মাসে উদযাপিত ‘মনসুন মেলায়’। এছাড়া, প্রতি বছরের মত এবছরও আগামী ১৬ ডিসেম্বর স্কুলের তরফ থেকে আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানে নিজেদের তৈরি করা নৃত্য ও মূকাভিনয় প্রদর্শন করবে পড়ুয়ারা।
সিনিয়র সেকশানের বরিষ্ঠ শিক্ষিকা অনিতা মুখার্জী জানান, ইলেভেন-টুয়েলভের ক্ষেত্রে আমরা সেইসব বিষয়গুলো বেছে নিই যেগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের পরবর্তী জীবনে কাজে লাগবে। যেমন হোম সায়েন্স, কম্পিউটার সায়েন্স, পেইন্টিং, বিজনেস স্টাডিজ পড়ানো হয়।
পাশাপাশি, বৈবাহিক সূত্রে বাংলাদেশে চলে যাওয়া ও পরে ফের নিজের দুই মেয়েকে নিয়ে দেশে ফিরে আসা এই স্কুলের শিক্ষিকা সুপর্ণা নাথ মনসুর বলেন, এই স্কুলে তিনি প্রায় দশ বছর ধরে পড়াচ্ছেন। তাঁর ছোট মেয়ে মূক-বধির হওয়ায় ২০১৩ সালে এই স্কুলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। তারপর থেকে তাঁর মেয়ে এই স্কুলেই পড়াশোনা করছে আর তিনিও এই স্কুলের একজন শিক্ষিকা হিসাবে যোগ দিয়েছেন।
একইসঙ্গে, ১৯৭৬ সালে এই স্কুলের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া ‘দি স্যোসাইটি ফর ওরাল এডুকেশন ফর দি ডেফ’-এর প্রেসিডেন্ট সাইরাস ম্যাডন জানান, যখন এই স্কুল শুরু হয়েছিল তখন মাত্র তিনজন পড়ুয়া ছিল। তবে, এখন সেই সংখ্যাটা বেড়েছে। বর্তমানে ৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে স্কুলে। এর মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি মুসলিম ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরাও রয়েছে। তবে, বর্তমানে কোনও পারসি পড়ুয়া স্কুলে নেই। কিন্তু নিজ সম্প্রদায়ের প্রেম নয়, মানবতার সেবার জন্যই এই স্কুলটি পরিচালনা করে যাচ্ছেন কলকাতার পারসি সম্প্রদায়।
পারসি সম্প্রদায় নিয়ে কিছু কথা
এ হাসান
পারসি সম্প্রদায়কে ভারত সরকার ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রকৃতপক্ষে সত্যিকারের সংখ্যালঘু হচ্ছে এই পারসি সম্প্রদায়। এরা ছিলেন পারস্য বা ইরানের বাসিন্দা। এই সম্প্রদায় অগ্নিপুজক। ইরানে পারসিদের সঙ্গে শাসকদের বিরোধের ফলে বেশির ভাগ পারসি দেশ ত্যাগ করেন। তাঁরা চলে আসেন উপকূলবর্তী ভারতে। পারসিদের কলকাতায় আগমনের যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রথম পারসি কলকাতায় আসেন ১৭৮০ খ্রিস্টাধ নাগাদ। মুর্শিদাবাদ সেইসময় ছিল এক বর্ধিষ্ণু নগর। কিছু পারসি নবাবের শহর মুর্শিদাবাদেও বসবাস শুরু করেন।
পারসিদের একটা বড় অংশ হচ্ছেন ব্যবসায়ী। স্যার জামসেদজি টাটার নাম শুনেননি এমন সচেতন মানুষ কমই আছেন। তাঁরা ইস্পাত থেকে শুরু করে বহু ব্যবসায় বিশ্বজুড়ে সুনাম করেছেন। বর্তমানে টাটা গ্রুপের রতন টাটা, সদ্য প্রয়াত সাইরাস মিস্ত্রি প্রভৃতি নামগুলি দেশের বাণিজ্য শিল্পমহলে সম্মানের সঙ্গে উচ্চারিত নাম। ভারতে পারসিরা এখন মুম্বই, বেঙ্গালুরু প্রভৃতি শহরে থাকেন। কলকাতায়ও পারসিদের রয়েছে উজ্জ্বল উপস্থিতি।
তবে পারসিদের একটি বড় সমস্যা হল, যেকোনও কারণেই হোক ভারত জুড়ে পারসিরা রয়েছেন তাঁদের জন্মহার ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। ফলে ভারতে পারসিদের সংখ্যা ৭০ হাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। কেন এই অবস্থা, তা জানার জন্য রিসার্চ করা হচ্ছে। এছাড়া ভারত সরকার পারসিদের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘জিও পারসি’ বলে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে।
কলকাতাতেও এখন পারসিদের সংখ্যা খুবই কম। তাদের জনসংখ্যা এখন এই শহরে মাত্র ৪০০-র মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। যারা রয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই বর্ষীয়ান। ফলে তাঁদের দেখাশোনা করা ও যত্ন নেওয়া এক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কলকাতার পারসি বাসিন্দারা বয়স্কদের যত্ন নেওয়ার জন্য এক সক্রিয় ব্যবস্থা করেছেন। আনন্দের কথা হচ্ছে, পারসিরা অন্যান্য জায়গার মতো বাংলার সমাজ জীবনেও একটি বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে।