ইন্তেখাব আলম: মুর্শিদাবাদ ভারতের অন্যতম জনবহুল জেলা। আর নবাবী জেলা মুর্শিদাবাদ শিক্ষায় ও দারিদ্র্যের সূচকে ব্যাপকভাবে পিছিয়ে ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কলকাতায় আসেন।
বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে রোজ বৃহৎ সংখ্যক মানুষকে চিকিৎসা, শিক্ষা ও সরকারি-বেসরকারি নানা প্রয়োজনে কলকাতায় আসতে হয়। মুর্শিদাবাদ থেকে ভিন রাজ্য কিংবা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষা, চাকরি অথবা অন্য কাজে যাওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। কলকাতায় সাময়িক আশ্রয়ের জন্য মুর্শিদাবাদবাসীর একমাত্র ভরসা বেসরকারি হোটেল। কিন্তু মোটা টাকা খরচ করে হোটেলে থাকা-খাওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না।
মুর্শিদাবাদের অধিবাসীদের এই দুর্ভোগ থেকে বাঁচাতে প্রায় বেশ কয়েক বছর আগে কলকাতার নিউ টাউনে ‘মুর্শিদাবাদ ভবন’ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জেলাগুলির বাসিন্দাদের সমস্যার কথা বিবেচনা করে বিভিন্ন জেলার ভবন নির্মাণে অনুমোদন দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী বেশ কয়েকটি জেলার ভবনও গড়ে উঠেছে।
মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় হিডকোর কাছ থেকে পাঁচ কাঠা জমি কিনেছিল ‘মুর্শিদাবাদ ভবন’ নির্মাণ করার জন্য। জমি কেনার পরও দীর্ঘদিন ফাঁকা অবস্থায় পড়ে ছিল প্রস্তাবিত ‘মুর্শিদাবাদ ভবনের’ সেই জমি। ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদ।
নিউ টাউনের বিশ্ব বাংলা গেট থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বেই তৈরি হয়েছে ঝাঁ-চকচকে ‘মুর্শিদাবাদ ভবন’ ।
পাঁচতলা এই ভবনে থাকার জন্য রয়েছে বেশ কিছু রুম, গাড়ি পার্কিং সুবিধা, ডাইনিং হল ছাড়াও মুর্শিদাবাদ ভবনে রয়েছে ডর্মিটরি এবং সভাকক্ষ।
কলকাতার নিউ টাউনের প্রাণকেন্দ্রেই নির্মিত হয়েছে সব রকম সুবিধাসম্পন্ন বহুতল ‘মুর্শিদাবাদ ভবন’ । পাশেই রয়েছে লেপচা ভবন এবং মিজোরাম হাউস।
মুর্শিদাবাদ জেলার বাসিন্দাদের জন্য কলকাতায় থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করতে ‘মুর্শিদাবাদ ভবনের’ কাজ দ্রুত সম্পন্ন করে খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মুর্শিদাবাদ ভবন পরিচালনার জন্য অনলাইন টেন্ডার দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে। জানা গিয়েছে, জেলা পরিষদের দেওয়া শর্তাবলি মেনেই ভবন পরিচালনার জন্য বরাত পেয়েছে বেসরকারি একটি সংস্থা। নিয়ম মেনে সব কিছু হয়ে যাওয়ার পরও মুর্শিদাবাদ ভবনের সুবিধা এবং পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ওই জেলার মানুষ।
এই মুর্শিদাবাদ ভবন নির্মিত হওয়ার পরও কেন তার সুযোগ-সুবিধা মুর্শিদাবাদের সাধারণ মানুষকে দেওয়া হচ্ছে না, সেটা অবশ্যই এক গুরুতর প্রশ্ন। কি অবস্থায় আছে ‘মুর্শিদাবাদ ভবন’ জানার জন্য দিন কয়েক আগেও নিউ টাউনের মুর্শিদাবাদ ভবনে গিয়ে দেখা গেল প্রধান প্রবেশদ্বার বাইরে থেকে তালাবন্ধ।
ভবনের মূল প্রবেশ দরজার সামনে গজিয়ে উঠেছে ঝোপঝাড়। এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইট, বালি আর পাথরের স্তূপ। ভবনের প্রবেশদ্বারের সামনে জল জমে কার্যত মশার বংশবিস্তারের আদর্শ স্থানে পরিণত হয়েছে।
কেউ কেউ বললেন, দাদা পানি জমেনি, জমিয়ে রাখা হয়েছে, প্রতিবেশী স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, খাতায় কলমে মুর্শিদাবাদ ভবনের ঠিকানা দেখে এখানে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যান মুর্শিদাবাদ থেকে আগত বহু মানুষ।
স্থানীয় ই-রিকশা চালক কামাল সেখ জানালেন, দিন কয়েক আগেও অসুস্থ রোগী-সহ কয়েকজন এখানে থাকার জন্য এসেছিলেন। কিন্তু ভবনের গেটে তালা ঝুলতে দেখে বাধ্য হয়ে ফিরে যান।’
মুর্শিদাবাদ ভবনের বর্তমান হাল-হকিকত সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের প্রাক্তন এক কর্মাধ্যক্ষ বলেন, নিউ টাউনে মুর্শিদাবাদ ভবনের টেন্ডার বিষয়ক সমস্ত কাজ হয়ে গেছে। এমনকী জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় নথিপত্র হস্তান্তরও করে দেওয়া হয়েছে বরাত পাওয়া সংস্থাকে। কিন্তু কেন এখনও পরিষেবা চালু করা সম্ভব হল না, তা বলতে পারছি না।
অন্যদিকে, মুর্শিদাবাদ ভবন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করা সংস্থাটির এক কর্ণধার শোনালেন ভিন্ন কথা। তিনি জানান, গত জুন মাসে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের কাছ থেকে আমরা ওই ভবন চালানোর প্রয়োজনীয় নথিপত্র হাতে পেয়েছি। কিন্তু, ‘মুর্শিদাবাদ ভবন’এ পানি সংযোগের ব্যবস্থা এখনও করে দিতে পারেনি। তাঁর দাবি, পানি সংযোগ না থাকায় নাকি ভবন চালু করা যাচ্ছে না। তাঁর আরও বক্তব্য, পানি সংযোগের অভাবে কিছু কিছু কাজ এখনও বাকি রয়ে গেছে।
মুর্শিদাবাদ ভবন নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, মুর্শিদাবাদ ভবনে মোট ১৫টি রুম আছে। তিনটি ডর্মিটরিতে মোট একুশটি বেড রয়েছে। রয়েছে ১৬ আসনের ডাইনিং হল এবং আনুমানিক ৫০ আসনের সভাকক্ষ। মুর্শিদাবাদের বাসিন্দাদের জন্য ভবন খুলে দেওয়া হবে বলে এই প্রতিবেদকে জানালেন তিনি। কিন্তু কেন এই ভবনটিকে বন্ধ ও বিরান করে রাখা হয়েছে তারসঠিক কোনও ব্যাখ্যা ওই ব্যক্তি দিতে পারলেন না। ওই এলাকার অন্যান্য বাড়ি ও ভবনে পানির ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন মুর্শিদাবাদ ভবনে কে বা কারা পানি দিচ্ছে না, তাও তিনি স্পষ্ট করে জানাতে পারলেন না। অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমেই থাকার জন্য ঘর বুকিং ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানান ওই সংস্থার অন্যতম কর্ণধার।
তবে মুর্শিদাবাদ ভবনে থাকা-খাওয়ার জন্য দিন প্রতি কত টাকা গুনতে হবে মুর্শিদাবাদবাসীকে, সেব্যাপারে এখনই কিছু জানানো সম্ভব নয় বলেও জানান বরাদ্দ পাওয়া সংস্থার সেই কর্ণধার।
অনেকে বলছেন, মুর্শিদাবাদ ভবন পরিচালনা ও ক্যান্টিনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রখ্যাত ও প্রভাবশালী অবাঙালি এক গায়কের আত্মীয়দের।
তাঁদের নাকি মুর্শিদাবাদ ভবন নিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে, যা জেলা ভবনগুলির ঘোষিত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আর যাকে কেয়ারটেকার বলা যেতে পারে এই ধরনের মাত্র একজন তরুণকে খুঁজে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, আমি কোনও প্রশ্নের জবাব দেব না। মালিকদের জিজ্ঞাসা করুন।
সে যাই হোক, মুর্শিদাবাদবাসীরা এখনও আশা করেন, হয়তো একদিন এই ভবন খুলবে। তাঁরা এখানে কলকাতার কাজের জন্য দিনকয়েক মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারবেন।