মুহাম্মাদ উসমান গনী: ভাষা আল্লাহর দান, আল্লাহ্তায়ালার সেরা নেয়ামত। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্যতম। ভাষা মনুষ্যপরিচয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাণিকুল, পশুসমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্যের মোক্ষ উপাদান হল ভাষা। মাতৃভাষা মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম সব ভাষাকে সম্মান করতে শেখায়। কারণ সব ভাষাই আল্লাহর দান ও তাঁর কুদরতের নিদর্শন। পবিত্র কুরআন কারিমে আল্লাহ্তায়ালা বলেন: ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রূম, আয়াত: ২২-২১)
আল্লাহ্ তায়ালার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘আশরাফুল মখলুকাত’ হল মানুষ। মানুষ ভাষা দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে এবং একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। মানুষের পরিচয় বা সংজ্ঞায় আরবিতে বলা হয়, ‘হায়ওয়ানুন নাতিক’, অর্থাৎ ‘বাকশক্তিসম্পন্ন প্রাণী’।
ভাষা বা বর্ণে নয়, কর্মেই পরিচয়
সব মানুষ একই পিতামাতার সন্তান। সবারই পিতা বাবা হযরত আদম আ., সবারই মাতা মা হাওয়া আ.। সাদা- কালো, লম্বা-খাটো, সেতো আল্লাহর সৃষ্টি। বর্ণবৈষম্য, ভাষাবৈষম্য এবং ভৌগোলিক ও নৃতাত্ত্বিক পার্থক্য মানুষে-মানুষে কোনও ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না। পবিত্র কুরআনে কারিমে আল্লাহ্তায়ালা বলেন: ‘হে মানুষ! আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অন্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে বেশি মুত্তাকি। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সবকিছু জানেন, সব খবর রাখেন।’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১৩)
সব নবী-রাসূল স্বজাতির ভাষাভাষী ছিলেন
মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. বলেছেন: ‘তিন কারণে তোমরা আরবিকে ভালোবাসো; যেহেতু আমি আরবি, পবিত্র কুরআন আরবি এবং জান্নাতের ভাষাও হবে আরবি।’ (বুখারী)
সর্বশেষ আসমানি কিতাব ফুরকান বা কুরআন আরবি ভাষায় সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রতি নাযিল করা হয়েছে।
বিদায় হজের ভাষণে নবী করিম সা. বলেছেন: ‘কালোর ওপর সাদার প্রাধান্য নেই, অনারবের ওপর আরবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই।’ (বুখারী শরিফ)
সুতরাং কোনও ভাষাকে হেয় জ্ঞান করার অবকাশ নেই, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই ও অবহেলা করার অধিকার নেই।
কেননা, ভাষার স্রষ্টা মহান আল্লাহ্। তাঁর সৃষ্টির অবমূল্যায়ন করা তাঁর প্রতি অসম্মান প্রদর্শনেরই নামান্তর। আল্লাহ্তায়ালা বলেন : ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকেই তাঁর স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি তাঁদের কাছে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।’ (সূরা ইব্রাহীম, আয়াত: ৪)
মহাগ্রন্থ আল্ কুরআন আরবি ভাষায় নাযিল করার কারণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্তায়ালা স্বয়ং ব্যাখ্যা প্রদান করেন এভাবে : ‘আমি অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায় কুরআন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সূরা১২ ইউসুফ, আয়াত : ২)
আরবদের কাছে আরবি কিতাব আল্ কুরআন নাযিল করা হয়েছে। কারণ তাদের মাতৃভাষা আরবি; অন্য ভাষায় নাযিল করলে তাদের বুঝতে এবং অনুসরণ করতে অসুবিধা হ’ত।
ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা করা সুন্নত
শুদ্ধ ভাষা ও সুন্দর বর্ণনার প্রভাব অনস্বীকার্য। আমাদের প্রিয় রাসূল সা. ছিলেন ‘আফসাহুল আরব’ তথা আরবের শ্রেষ্ঠ বিশুদ্ধ ভাষী। সুতরাং বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় কথা বলা নবীজি সা.-এর সুন্নত। কুরআনুল করিমের বর্ণনা : ‘দয়াময় রহমান আল্লাহ্! পবিত্র কুরআন পাঠ শেখালেন, মনুষ্য সৃজন করলেন, তাকে ভাষা বয়ান শিক্ষা দিলেন।’ (সূরার্আ রহমান, আয়াত: ১-৪)
ভাষাচর্চা ইবাদাত। আরবি ভাষার ব্যাকরণ মুসলমানদের হাতেই রচিত হয়। অনারবদের পবিত্র কুরআন পড়তে সমস্যা হ’ত বিধায় হযরত আলী রা. তাঁর প্রিয় শাগরেদ / শিষ্য হযরত আবুল আসওয়াদ দুওয়াইলি(রা.-কে নির্দেশনা দিয়ে আরবি ভাষাশাস্ত্র প্রণয়ন করান, যা ইলমে নাহু ও ইলমে সরফ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে উচ্চতর ভাষাতত্ত্ব ইলমে বায়ান, ইলমে মা’আনি ও ইলমে বাদির উন্নয়ন ঘটে; যার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন ইমাম আবদুল কাহির জুরজানি রা. / রহ. ও ইমাম জামাখশারি রহ. /রা.।
শেখ আবদুর রহমান জামি রহ. /রা. পারস্যবাসী হয়েও বিশ্বের সেরা আরবি ব্যাকরণের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ গ্রন্থ শারহে জামি (ফাওয়ায়িদে জিয়াইয়া) রচনা করেন, যা শাফিয়া গ্রন্থের প্রণেতা ইমাম ইবনে হাজিব রহ. /রা. প্রণীত কাফিয়া গ্রন্থের ব্যাখ্যা। এই গ্রন্থের আরও জগদ্বিখ্যাত বিশেষণ পুস্তক রয়েছে; সুওয়ালে কাবুলি, সুওয়ালে বাসুলি, তাহরিরে চম্বট ইত্যাদি এর অন্যতম।
সাহিত্যচর্চাও ইবাদাত
সুসাহিত্য রচনাও ইবাদাত। আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘হে নবী! আমি আপনার প্রতি সর্ব সুন্দর কাহিনি বর্ণনা করেছি।’ (সূরা১২ ইউসুফ, আয়াত: ২)
প্রিয় নবী সা. নিজে কাব্য করতেন। বিখ্যাত সাহাবি হযরত হাসসান বিন সাবিত রা. কাব্য রচনা করতেন। হযরত আয়িশা রা. কাব্যচর্চা করতেন। এভাবে ইসলামের সব যুগেই বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্যচর্চা চলে আসছে।
সত্য প্রচার ও দাওয়াতি কাজে ভাষার প্রভাব
আল্লাহ্তায়ালা মানুষের হিদায়াতের জন্য নবী-রাসূলদের পাঠিয়েছেন। সব নবী-রাসূলের ধর্ম প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল দাওয়াত তথা মহা সত্যের প্রতি আহ্বান। আর এর জন্য ভাষার কোনও বিকল্প নেই। আল্লাহ্তায়ালা হযরত মুসা আ.-এর প্রতি অহি নাযিল করলেন; তাঁকে নবী ও রাসূল হিসেবে ঘোষণা করলেন; তাঁর প্রতি তাওরাত কিতাব অবতীর্ণ করেন, তখন তিনি তাঁর ভাই হযরত হারুন আ.-কে নবী ও রাসূল হিসেবে ঘোষণা করার জন্য আল্লাহর সমীপে আরজ করলেন। কারণ, তিনি ছিলেন বাগ্মী, শুদ্ধ ও স্পষ্টভাষী সুবক্তা, আর হযরত মুসা আ.-এর মুখে ছিল জড়তা।
হযরত মুসা আ. কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘সে আমার অপেক্ষা বাকপটু’। পবিত্র কুরআন কারিমে এই বর্ণনাটি এভাবে উপস্থাপিত হয়েছে: মুসা (আ.) বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সিনা প্রশস্ত করে দিন এবং আমার কাজ সহজ করে দিন। আমার ভাষার জড়তা দূর করে দিন, যাতে তারা আমার কথা বুঝতে পারে। আমার জন্য একজন সাহায্যকারী বানিয়ে দিন আমার স্বজনদের মধ্য থেকে; আমার ভাই হারুনকে; তার দ্বারা আমার শক্তি সুদৃঢ় করুন এবং তাকে আমার (দাওয়াতি-প্রচার) কাজের শরিকদার করুন, যাতে আমরা আপনার পবিত্রতা ও মহিমা বেশি বেশি বর্ণনা করতে পারি এবং আপনাকে অধিক স্মরণ করতে পারি; আপনি তো আমাদের সর্বতো প্রত্যক্ষকারী।’ (সূরাত্বহা, আয়াত: ২৫-৩৬)