ফাইজান মুস্তাফা
যেদিন হরিয়ানার বিজেপি মুখপাত্র ও করণী সেনা প্রধান সুরজ পাল আম্মু মুসলমানদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার আহ্বান জানালেন, কাকতালীয় ভাবে সেইদিনই আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত মুসলমানদের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি ইতিবাচক কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। তিনি যেভাবে ধারাবাহিকতার সঙ্গে এই জাতীয় বক্তব্য দিয়েছেন তা তার বা সংঘ পরিবারের চিন্তায় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে কি না তা এখনও বলা শক্ত। তবে আরএসএসে কেউ যদি ‘সংস্কার’ শুরু করতে পারেন তবে তিনি মোহন ভাগবত। ধীরে ধীরে তিনি মুসলমানদের প্রতি সংঘের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করার চেষ্টা করছেন। আসুন আমরা এই গুরুত্বপূর্ণ এবং এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান পরিবর্তনটি বোঝার চেষ্টা করি।
ভাগবত একজন স্পষ্টবাদী ব্যক্তি। তিনি নিজের মনের কথা বলেন এবং সেটা চরমপন্থী হিন্দু গ্রুপগুলোর কাছ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার কোনও ভয় ছাড়াই। ইদানীং তিনি সংখ্যালঘুদের এবং বিশেষত মুসলমানদের সমস্যাগুলিই উচ্চারণ করেছেন। তাঁর মন্তব্যগুলি হঠাৎ করে হৃদয়ের পরিবর্তন প্রকাশ করে না। প্রকৃতপক্ষে, আরএসএস প্রধান কে এস সুদর্শনের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০২ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চ গঠিত হয়েছিল এবং বর্তমানে ইন্দ্রেশ কুমারের নেতৃত্বে সেটি চলছে৷ তিনিও ভাগবতের মতো বিশ্বাস করেন যে হিন্দু ও মুসলমানরা যখন পূর্বপুরুষ, সংস্কৃতি এবং এই মাতৃভূমিকে ভাগ করে নেন তখন সংঘাতের সুযোগ নেই। তিনি যথাযথভাবে বিশ্বাস করেন যে একবার হিন্দু ও মুসলমানরা ভারতের চেতনা ও আত্মাকে বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে পারলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেকার সমস্ত কৃত্রিম বাধা বিলীন হয়ে যাবে। আসল কথা হল, ১৫-১৭ কোটি মুসলমানকে ভারত থেকে ফেলে দেওয়া যায় না। কোনও ‘এনআরসি’ তাদের সবাইকে বাদ দিতে পারবে না। কোনও দেশই তাদের গ্রহণ করতে পারবে না। ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমানো বিহারি মুসলমানদেরও পাকিস্তান গ্রহণ করেনি। তবে এই ভারতীয় মুসলমান যারা সামন্তবাদী ও ধর্মতান্ত্রিক পাকিস্তানের পরিবর্তে উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশকে বেছে নিয়েছিল, তাদেরকে কীভাবে তারা গ্রহণ করবে?
রাষ্ট্রীয় মুসলিম মঞ্চ বা আরএমএম-এর প্রাথমিক কাজটি হল মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে অর্থবহ সংলাপ স্থাপন করা। এটি করার জন্য সামগ্রিকভাবে দেশে যে সমস্ত মুসলমানরা ব্যাপকভাবে সম্মানিত ও শ্রদ্ধেয় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা উচিত৷ বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ে মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির প্রশংসা করার চেষ্টা করা উচিত। উদার হিন্দু সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে অবশ্যই একে কিছুটা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে হবে, যারা তাদের নিজেদের নেতা বা রাজনৈতিক নেতাদের চেয়ে সাধারণ মুসলমানদের চোখে অনেক বেশি সম্মানের অধিকারী৷ রবিবার আরএমএমের একটি অনুষ্ঠানে ভাগবত একরকমভাবে স্বীকার করেন যে আজ অনেক মুসলমান সত্যই ভয়ে ডুবে আছেন৷ মোহন ভাগবত তাদেরকে অনুরোধ করেন, ‘ভারতে ইসলাম বিপদে রয়েছে’ এই ভয়ের মধ্যে আটকা পড়বেন না। আরএসএস প্রধান একই সঙ্গে হিন্দুত্বের পদাতিক সৈনিক এবং বিজেপি নেতাদের বলেন, হিন্দুরাও দেশে কোনও বিপদের মধ্যে নেই৷ যদিও সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলিতে এই বুলিটিকে একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক থিম হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। ভাগবত কড়া ভাষায় মবলিঞ্চিংয়ের নিন্দা করে বলেন, এই জাতীয় ঘটনাগুলি ‘হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে’ এবং যারা এতে লিপ্ত তারা হিন্দু নয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও লিঞ্চিংয়ের বিরুদ্ধে এই জাতীয় শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। আরএসএস প্রধান জোর দিয়ে বলেন যে, ‘হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বের একমাত্র সমাধান সংলাপ, বিভেদ নয়৷’ ৮০০ বছর পরে যারা হিন্দু শাসনের রাজত্ব হিসাবে মোদি সরকারের আগমনকে উদযাপন করেছিল তাদেরকে উপেক্ষা করে আরএসএস প্রধান সাহসের সঙ্গে বলেন, আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আছি। এখানে কোনও হিন্দু বা মুসলমানের আধিপত্য থাকতে পারে না। কয়েক মাস আগে একটি হিন্দি দৈনিককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, সংবিধানের কোথাও বলা হয়নি যে কেবল হিন্দুরা ভারতে বসবাস করতে পারবে বা এই দেশে কেবল হিন্দুদেরই বক্তব্য থাকবে বা ভারতে বেঁচে থাকার জন্য হিন্দু আধিপত্যকে মেনে নিতে হবে৷ তিনি আরও উল্লেখ করেছিলেন যে হলদিঘাটির (১৫৭৬) যুদ্ধে মুঘল ও রাজপুতদের মধ্যে লড়াই হয়েছিল৷ বিপুল সংখ্যক মুসলমান মহারাণা প্রতাপ সিংহের পক্ষে ছিলেন এবং অন্য রাজপুত রাজা মান সিংহের নেতৃত্বে মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন।
আরএসএস প্রধান বারবার বলে চলেছেন যে এই দেশের মুসলমানরা সমান নাগরিক৷ যেখানে হিন্দুত্ববাদী শক্তি ঐতিহাসিকভাবে দেশীয় ধর্ম এবং আব্রাহামিক (ইব্রাহিম আ.) ধর্মের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করার নিরন্তর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে, সেখানে তার এই স্বীকারোক্তি প্রশংসার দাবিদার। হিন্দু ও মুসলমানদের একই ডিএনএ রয়েছে বলার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের বিদেশি হওয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় যুক্তিটি নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তবে তার এও বলা উচিত যে নাগরিকত্ব প্রমাণে নথির অভাব এবং এনআরসি থেকে বাদ পড়ার পর ভারতীয় নাগরিকদের সঙ্গে ডিএনএ-ম্যাচিংকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বা অস্বীকার করার জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসাবে ব্যবহার করা উচিত।
১ জানুয়ারি জে কে বাজাজ এবং এম ডি শ্রীনিবাসের গ্রন্থ ‘মেকিং অফ এ হিন্দু প্যাট্রিয়ট: ব্যাকগ্রাউন্ড অফ গান্ধিজি’জ হিন্দ স্বরাজ’ উদবোধনের সময়েও ভাগবত হিন্দু জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ ধারণার বিরুদ্ধে মত পোষণ করেছিলেন, যেখানে ভূমি এবং অঞ্চলকে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ স্টাইলে তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রতি ভালোবাসা কেবল ভূমি দিয়ে বোঝায় না৷ এর অর্থ এখানকার মানুষ, নদী, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যকে আপন করে নেওয়া৷
সম্প্রতি, দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রামানাও বলেছেন যে জাতীয়তাবাদ অঞ্চলভিত্তিক নয়, মানবভিত্তিক৷ যাইহোক, রবিবার আরএমএমের ওই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রেখে এবং ক্রমাগত মুসলমানদের নিয়ে সদর্থক মন্তব্য করে আরএসএস প্রধান ঘৃণা ও ধর্মান্ধতার পরিবেশে আশার আলো হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি তিনি ধার্মিকতা, সহনশীলতা ও সহাবস্থান, যেগুলি সনাতন হিন্দু ধর্মের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য, সেগুলির পুনরুদ্ধার করতে পারেন।
এই হিন্দু-মুসলিম বাইনারিটি যদি দ্রুত শেষ করা হয় তবে ভারত অনেক বেশি শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হতে পারে। আসুন আমরা বৈচিত্র্যময় সহাবস্থানবাদী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য উদযাপনের দিকে মনোনিবেশ করি বিংশ শতাব্দীর কিছু সংকীর্ণ, প্রতিক্রিয়াশীল এবং সাম্প্রদায়িক মতবাদকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে৷ সংবিধানের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে আক্রমণাত্মক হিন্দুত্ববাদ বর্জনীয়৷ তবে উদার, সহিষ্ণু ও সর্বজনীন হিন্দু ধর্ম তেমনটা নয়৷ আরএসএস প্রধান হিন্দুত্ববাদ থেকে হিন্দু ধর্মে ফেরার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিন। বেদ ও উপনিষদের দিকে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি কি রাজা রামমোহন রায়ের হিন্দু নবজাগরণে ছিল না?