জাতীয় শিক্ষা দিবসে আলিয়ায় সেমিনার
কুরআনের শিক্ষাই এই মহান মানুষটিকে ‘আজাদ’ করেছিল: মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী
রাকিবুল আলম সেখ: শুক্রবার ছিল মাওলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন। ১৮৮৮ সালের ১১ নভেম্বর মক্কায় তাঁর জন্ম হয়েছিল। তারপর তাঁর পিতা মাওলানা মুহাম্মদ খায়রুদ্দিন পরিবার, সহ তাঁকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেই কলকাতার আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ক সার্কাস ক্যাম্পাস অডিটোরিয়ামে শুক্রবার মাওলানা আজাদকে নিয়ে একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
এই দিনটিকে দেশে জাতীয় শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। আজাদের চিন্তা, ভাবনা, আদর্শ এখনও যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, তা উঠে আসে এদিন সেমিনারে উপস্থিত বিশিষ্টদের ভাষণে। তিনি শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর ভারতের শিক্ষা মানচিত্রকে যেভাবে বদলে দিয়েছিলেন তার পর্যালোচনা করেন তাঁরা। সেমিনারের আলোচ্য বিষয় ছিল, ভারতে শিক্ষাক্ষেত্রে নয়া প্রবণতাn সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ। সে সম্পর্কেও আলোচনা করেন বক্তারা।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টের প্রধান জনাব ড. জাকির হোসেন লস্কর প্রথমেই এই সেমিনারের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য তুলে ধরেন। পুবের কলম পত্রিকার সম্পাদক ও প্রাক্তন সাংসদ আহমদ হাসান ইমরান মাওলানা আবুল কালাম আজাদকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন বাংলারই ভূমিপুত্র।
কলকাতাতেই তাঁর শিক্ষাগ্রহণ ও বেড়ে ওঠা। কিন্তু আমরা ইদানিং তাঁকে মনে করি তিনি বোধহয় দিল্লি বা ইউপি’র মানুষ। কিন্তু আদৌ তা নয়। এই বাংলার সঙ্গেই রয়েছে তাঁর নাড়ির যোগ। তাঁর পরিবারের সকলের কবরও মানিকতলা কবরস্থানে রয়েছে। তাঁর বাড়িও রয়েছে কলকাতার বালিগঞ্জে। বলা হয় সেখানে একটি মিউজিয়াম আছে। কিন্তু খুব কম লোকই মাওলানা আজাদের বাড়ি, যা পরে মিউজিয়াম করার চেষ্টা হয়েছিল, সেখানে যান। তাঁকে কিন্তু বাংলার ভূমিপুত্র হিসেবে আমাদেরকে স্মরণ করতে হবে।
দ্বিতীয় একটি কথা খুবই জরুরি, আর তা হল আজ যে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন-তিনটি ক্যাম্পাস আছে ও এখানে সায়েন্স, আর্টস, থিওলজি এবং আরবি ভাষা পড়ানো হয় তা অবশ্যই গর্বের। কিন্তু আপনারা শুনলে অবাক হবেন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ না থাকলে এই আলিয়া মাদ্রাসার স্বাধীনতার সময়ে অপমৃত্যু ঘটত।
কারণ, ১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর কিছু আমলার ধারণা হয়, ১৭৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই আলিয়া মাদ্রাসার আর কোনও প্রয়োজন নেই। তাঁরা চেষ্টা করেন আলিয়া মাদ্রাসাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতে। দেখা যায়, আলিয়া মাদ্রাসার চেয়ার, টেবিল, বেঞ্চ এবং বইপত্র সমস্ত কিছু ঢাকায় স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়। মাওলানা আজাদ যখন জানতে পারলেন, এই ঐতিহ্যবাহী আলিয়া মাদ্রাসাকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন তিনি তা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। এমন কী এ বিষয়ে মাওলানা আজাদ জওহরলাল নেহরুর সঙ্গেও কথা বলেন।
ফলে আলিয়া মাদ্রাসা তালতলা ক্যাম্পাসে পুনরায় শুরু হয়। যদি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এই মাদ্রাসাকে নতুন করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত না করতেন, তাহলে হয়তো আজ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হত না। কারণ, আলিয়া মাদ্রাসায় ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা ধরেই আজ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। এ জন্য আমাদের সকলকে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।’
ইমরান আরও বলেন, ভারতের শিক্ষাক্ষেত্রে মাওলানা আজাদের যে অবদান রয়েছে, তা এখানে উপস্থিত স্কলার ও বিশেষজ্ঞরা বলবেন। আমি শুধু বলব, মাওলানা আজাদ গ্রামীণ ভারতে শিক্ষা ও নারী শিক্ষার প্রসার এবং ১৪ বছর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকার পড়াশোনার উপর জোর দিয়েছিলেন। এ কথা সকলেই জানেন, মাওলানা আজাদ আধুনিক ভারতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে আইআইটি এবং ইউজিসি প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের প্রযুক্তিগত উন্নতিতে তাঁর দূরদৃষ্টি ও ভূমিকা যথেষ্ট তাৎপর্য রাখে।’
এদিন জাতীয় শিক্ষা দিবসের সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের গণশিক্ষা ও গ্রন্থাগার বিষয়ক মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী। এছাড়া ছিলেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু তাহের কমরুদ্দীন, আল-আমীন মিশনের সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম, কন্যাশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মিতা ব্যানার্জী, রানি রাসমণি গ্রিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আশুতোষ ঘোষ, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নুরুস সালাম, ডেপুটি রেজিস্ট্রার আসফাক আলি, অধ্যাপক এইচ সেনাপতি, ড. আমজাদ হোসেন, ড. আবদুর রহিম গাজী, অধ্যাপক নিত্যানন্দ প্রধান প্রমুখ।
মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ প্রসঙ্গে বলেন, আরবি, ফারসি ও উর্দু এই তিন ভাষায় নিজ ঘরে থেকেই আবুল কালাম আজাদ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তিনি কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ডের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশোনা করেননি। সেই মানুষটিই আমাদেরকে শিক্ষাক্ষেত্রে পরিকাঠামোতে উজ্জ্বল দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
কুরআনের শিক্ষাই এই মহান মানুষটাকে ‘আজাদ’ করেছিল। তবে আজকে পৃথিবী উল্টো দিকে হাঁটছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে যে বর্তমান ভারত সরকার সেই মানুষটাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে না। এমনকি রাজ্য সরকারও নয়। তিনি এদিন নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে মাওলানা আবুল কালাম আজাদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথাও উল্লেখ করেন।
বলেন, আবুল কালাম আজাদের লেখনী বহু যুবককে ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। মাওলানা আজাদ অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখতেন। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল এবং মহম্মদ আলী জিন্নাহ-র দেশভাগের জেদ তাঁকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ মনোভাব নিয়ে চলতেন।
কন্যাশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মিতা ব্যানার্জী বলেন, মাওলানা আজাদ শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নতি করতে তাঁর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। শিক্ষা, ধর্মীয়, সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সমতার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করেন। উপাচার্য আশুতোষ ঘোষ বলেন, ভারতের প্রকৃত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নয়নে মাওলানা আজাদ সদর্থক ভূমিকা রেখেছেন। তিনি জানান, করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাব্যবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরই সবথেকে বেশি ভূমিকা নিতে হবে।
আল-আমীন মিশনের সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম বলেন, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের জন্মদিন উপলক্ষে শুধুমাত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং দু’চার কথা বলে পরবর্তীতে তাঁকে ভুলে গেলে চলবে না। তাঁর সম্পর্কে আরও বেশি বেশি জানতে হবে এবং তাঁর দেখানো পথকে কাজে লাগাতে হবে। স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী হয়ে তিনি রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষাক্ষেত্রে এদেশের মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছেন।
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবু তাহের কমরুদ্দিন মাওলানা আজাদ নারী শিক্ষার প্রতি যে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন সে বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মাওলানা আজাদ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরির সময় নারী শিক্ষার কথা ভেবে পরিকাঠামোগত দিকটি গড়ে তুলতেন। তিনি শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমান নয়, পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যে ঐক্য এবং সাম্য স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।