পুবের কলম প্রতিবেদক: একদিকে সাগরদিঘি বিধানসভা উপনির্বাচনে তৃণমূলের পরাজয়। অন্যদিকে, সামনে আবার পঞ্চায়েত ভোট। এই আবহে শুক্রবার কালীঘাটে হল মেগা বৈঠক। তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই বৈঠক হয়। সেখানে দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। সামনের পঞ্চায়েত ও পরের বছর লোকসভা-আগামী দিনের ভোটগুলিতে তৃণমূলের রণকৌশল কী হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। দু’ঘণ্টার বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজ্যের অর্থ প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যা বললেন, তার নির্যাস এই যে-পঞ্চায়েত ভোটের পাশাপাশি ২০২৪-এর লোকসভা ভোটও বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
এদিন দুপুর আড়াইটা নাগাদ কালীঘাটের নবনির্মিত অফিসে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে শুরু হয় বৈঠক। বৈঠকে যোগ দেন দলের জেলা সভাপতি, সভাধিপতি, বিধায়ক ও সাংসদরা।
জানা গিয়েছে, বৈঠকের শুরুতে সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে মমতা খোঁজ নেন, দিদির সুরক্ষা কবচ, কতটা কার্যকর হচ্ছে তা নিয়ে। আসলে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের কথা মাথায় রেখেই যে নেত্রী এই বিষয়গুলি জানতে চেয়েছে এটা স্পষ্ট। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে যুব সংগঠনগুলিকে রাস্তায় নামার নির্দেশ দিয়েছেন নেত্রী। রুদ্ধদ্বার বৈঠকে গোড়াতেই তৃণমূল নেত্রী দুর্নীতি ইস্যুতে কথা বলেন। দলের নেতাদের প্রতি তাঁর বার্তা, ‘যারা দুর্নীতি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার হচ্ছে।
আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা হস্তক্ষেপ করি না। সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি একজোট হয়ে অপপ্রচার করছে। তবে কোনও চিন্তা করবেন না, আপনারা মাথা উঁচু করে কাজ করুন। বুক ফুলিয়ে মানুষকে বোঝান, আমরা আমাদের টাকায় গ্রামীণ রাস্তা করছি। এতে কেন্দ্রের টাকা নেই।’ ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ ও ‘দিদির দূত’ কর্মসূচি পালনে সকলকে কড়া বার্তা দিয়ে এই কর্মসূচি সফলে সবাইকে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন নেত্রী।
বৈঠক শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে যোগ দেন সুদীপ ও চন্দ্রিমা। তাঁদের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় পঞ্চায়েত ও লোকসভা ভোট নিয়ে তৃণমূল কি ভাবছে। সাগরদিঘির পরাজয় ছিল এদিন আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোশারফ হোসেনকে করা হয় সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি। এই পদে আগে ছিলেন হাজী নুরুল। মনে করা হচ্ছে সাগরদিঘি ভোটে সংখ্যালঘু ভোট সেভাবে তৃণমূলের ঝুলিতে না আসায় এই রদবদল। যদিও তৃণমূলের দাবি, সংখ্যালঘুদের ভোট তাদের সঙ্গেই আছে।
সাগরদিঘিতে হার হয়েছে নিজেদের দুর্বলতার কারণে। তবে হারের কারণ খুঁজতে আগেই কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন নেত্রী। এবার সংখ্যালঘু সেলের সভাপতিও বদলে দিলেন। এতদিন এই পদে ছিলেন হাড়োয়ার বিধায়ক হাজি নুরুল। তাঁর জায়গায় বসানো হল ইটাহারের বিধায়ক মোশারফ হোসেনকে। হাজি নুরুলকে অবশ্য সভাপতি পদ থেকে সরানো হলেও তাঁকে ওই সেলের চেয়ারম্যান করা হয়েছে। সেই পদে এতদিন ছিলেন গ্রন্থাগারমন্ত্রী সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরি। সিদ্দিকুল্লাকে মুর্শিদাবাদ ও মালদহ’র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফিরহাদ হাকিমকে দেওয়া হয়েছে হাওড়া, হুগলির দায়িত্ব। অরূপ বিশ্বাসকে দেওয়া হয়েছে নদিয়া, পূর্ব বর্ধমান ও দার্জিলিং জেলার সংগঠনের দায়িত্ব। মলয় ঘটককে দেওয়া হয়েছে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া ও পশ্চিম বর্ধমান।
রাজ্যে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জেলার মধ্যে অন্যতম মুর্শিদাবাদ, মালদহ ও উত্তর দিনাজপুর। এই দুই জেলায়û সংগঠন দেখবেন সিদ্দিকুল্লাহ। তাঁকে সহযোগিতা করার জন্য আরও দুই মুসলিম নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মোথাবাড়ির বিধায়ক তথা রাজ্যের সেচ প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন এবং রাজ্যসভার সাংসদ নাদিমুল হক সিদ্দিকুল্লার সঙ্গে থাকবেন। হাজি নুরুলকে সংখ্যালঘু সেলের সভাপতি থেকে চেয়ারম্যান করার পাশাপাশি বসিরহাট জেলার তৃণমূলের চেয়ারম্যানের পদে রাখা হয়েছে।
আর অনুব্রতর গড় বীরভূমের দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছেন মমতা। তাপস রায়কে দেওয়া হয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুরের দায়িত্ব। সুদীপ জানান, মাসে তিন দিন করে জেলাভিত্তিক বৈঠক করবেন মমতা। সংগঠনের শক্তি বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জানা গিয়েছে, সরকারের কিছু কাজের সমালোচনা করার জন্য নেত্রীর ধমক খেয়েছেন রাজ্যের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আখরুজ্জামান ও বিধায়ক ইদ্রিশ আলি। দলের যুব সভাপতি সায়নী ঘোষ বৈঠকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বলেন, ‘আমি সংগঠন শক্তিশালী করতে পারিনি।’
আঞ্চলিক স্তরে এই সিদ্ধান্তগুলি নেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় স্তরে নিজেদের পরিকল্পনার কথাও ঘোষণা করেছেন সুদীপ-চন্দ্রিমা। সুদীপ জানান, তাঁরা এখনই তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের কথা বলছেন না। কিন্তু যে সব দল নিজ নিজ রাজ্য যথেষ্ট শক্তিশালী, তাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন দলনেত্রী। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হবে কি?
সেই প্রশ্নে তৃণমূলের অবস্থান স্পষ্ট করে সুদীপ বলেন, যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী সেই দল বিজেপির বিরুদ্ধে লড়বে। কংগ্রেস যেমন কর্ণাটকে শক্তিশালী, সেখানে কংগ্রেসকে কোনও অবিজেপি দল বিরক্ত করছে না। তাহলে কংগ্রেসের উচিত অন্য রাজ্যে যে আঞ্চলিক দলগুলি বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করছে তাদের সহযোগিতা করা। কিন্তু কংগ্রেস সে পথে হাঁটছে না। কংগ্রেসের বিগ-বসের মতো আচরণ তৃণমূল মানবে না।
বিজেপি চায় লোকসভা নির্বাচনে রাহুল গান্ধি কংগ্রেসের মুখ হোক, যাতে সহজে কংগ্রেসকে হারানো যায়। বাংলায় বিজেপি-সিপিএম-কংগ্রেস এক হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়ছে। তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলবে। দল দুর্নীতির সঙ্গে আপোষ করবে না বলেও এদিন স্পষ্ট করে দিয়েছেন সুদীপ। সুদীপ আরও বলেন, তৃণমূল একলা চলার ক্ষমতা রাখে। তবে, আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গেও তৃণমূলের কথাবার্তা চলছে। সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবের সঙ্গে বৈঠকের পর ২৩ মার্চ ওড়িশায় যাবেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সঙ্গে বৈঠক করবেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। তারপর দিল্লি যাবেন। এনডিএ জোটে থাকা ১৫টি পার্টি বিজেপিকে ছেড়ে এখন কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। তৃণমূল তাদেরকেও সঙ্ঘবদ্ধ করে ২০২৪ সালে ভোটে লড়ার কথা ভাবছে।