আবদুল ওদুদ, মিনা থেকেঃ শুক্রবার শুরু হয়েছে ২০২৪ সালের পবিত্র হজ। পবিত্র হজের প্রথম দিন সারাবিশ্বের ২০ লক্ষের বেশি মানুষ তাঁবুর শহর মিনায় উপস্থিত হন। পুরো শহর ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। সেলাইবিহীন সাদা কাপড় (ইহরাম) পরে মিনার উদ্দেশে যাত্রার মধ্যে দিয়েছে শুরু হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা। বিশ্বে চলমান হিংসা-হানাহানি-রক্তপাত সবকিছু উপেক্ষা করে আধ্যাত্মিকতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে শান্তি ও কল্যাণের বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন এই হজযাত্রীরা। ফিলিস্তিনের মজলুমদের জন্য চোখের পানিতে দোয়া করেন বহু হাজী।
হিজরি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী শুক্রবারই ছিল হজের প্রথম দিন। এ দিন তাঁবুর শহর মিনায় সমস্ত হাজীরা যোহর, আসর, মাগরিব, এশা এবং ৯ যিলহজের ফযরের নামায পড়েন। সারাদিন তাঁবুতে আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁবুতে তাঁবুতে আল্লাহ্র জিকির ও কুরআন তেলাওয়াতে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন হাজীসাহেবরা। এ ছাড়াও নিজের গুনাহর জন্য আল্লাহ্র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাঁরা।
পবিত্র শহর মিনায় হজযাত্রীরা রাত থেকে সকাল পর্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। সকালে সউদি সরকারের হজমন্ত্রকের অধীনে থাকা বিভিন্ন সহযোগী সংস্থার পক্ষ থেকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয় হাজীদের জন্য। পর্যাপ্ত পানীয় জল, চা, বিস্কুট, কফি সমস্ত পরিষেবা অব্যাহত ছিল।
শুক্রবার হাজীরা জুম্মার নামাযে শামিল হন তাঁবুর শহরে। যাঁরা মসজিদে যেতে পারেননি তাঁরা জামাত করে নিজ নিজ তাঁবুতেই জুম্মার নামায আদায় করেন। ‘মসজিদে খাইফে’ জুম্মার নামায অনুষ্ঠিত হয়। হজযাত্রীরা মিনার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানও ঘুরে দেখেন। কারণ, ১০ যিলহজের পর জামারায় খুব ভিড় থাকে। তখন ভালো করে আর দেখা যায় না। শনিবার অর্থাৎ আজ হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। শনিবার সকালেই হাজীরা আরাফার ময়দানে সমবেত হবেন। আরাফাতে যাওয়ার পথে হাজীরা প্রত্যেকে তালবিয়া বা লাব্বাইক এবং তাকবীর পড়তে থাকবেন। রাস্তায় অত্যধিক জ্যাম থাকার কারণে সকলকে হেঁটেই যেতে হতে পারে আরাফার ময়দানে।
হাজারো কণ্ঠে আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে যিলহজ মাসের নবম দিনে আরাফার ময়দানে সম্পন্ন হবে পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। বিদায়ী হজের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ময়দানটি প্রকম্পিত হবে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে। নবী হযরত মুহম্মদ সা. এই আরাফাতের ময়দানেই বিদায়ী হজের ভাষণটি দিয়েছিলেন। এ বছর পবিত্র হজের খুতবা দেবেন শায়খ মাহের আল মুয়াইকিলি। আজ শনিবার আরাফার ময়দানে অবস্থানরত বিশ্বের ধর্মপ্রাণ হজযাত্রীদের উদ্দেশে খুতবা দেবেন তিনি। আরাফাতের ময়দানের মূল পর্ব শেষে রবিবার জামারাতে শয়তানের প্রতীকে পাথর ছুড়ে, পশু কুরবানি করে ঈদ উদ্যাপন করবেন হাজীগণ।
গাজা যুদ্ধের ভয়াবহ পটভূমি এবং কষ্টকর গ্রীষ্মের উত্তাপের মধ্যেই হচ্ছে এবারের হজ। হজ পালনকারীরা অনেকেই ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে আট মাস ধরে চলা যুদ্ধের ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করেন। মরক্কোর ৭৫ বছর বয়সি জাহরা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে বলেন, ফিলিস্তিনে আমাদের ভাইয়েরা মারা যাচ্ছেন এবং আমরা আমাদের নিজের চোখে তা দেখতে পাচ্ছি।
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়ার এলহাম বলেন, আমি হজ চলাকালীন প্রতিদিন দোয়া করব যাতে ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তার যেন অবসান ঘটে। ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীর থেকে হাজারো ফিলিস্তিনি হজ পালন করতে গেলেও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা থেকে কোনও ফিলিস্তিনি এবার হজে যেতে পারেননি। গাজার মানুষ সাধারণত রাফাহ ক্রসিং দিয়ে প্রথমে মিশরে যান। এরপর সেখান থেকে তারা সউদিতে পৌঁছন। কিন্তু মে মাস থেকে এই ক্রসিংটি বন্ধ করে রেখেছে ইসরাইলিরা। অন্যদিকে, সউদি আরব কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধে নিহত ও আহত ফিলিস্তিনিদের পরিবারের ১ হাজার সদস্য এবার বাদশাহ সালমানের আমন্ত্রণে হজ করতে এসেছেন। কিন্তু তারা কেউই সরাসরি গাজা থেকে আসেননি।
মতিউল্লাহ কুরেশি একজন ভারতীয়। মাকে নিয়ে পবিত্র হজ পালন করা ছিল তাঁর সেই ছোটবেলার স্বপ্ন। পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে এ বছর তাঁর হজ পালনের স্বপ্নপূরণ হচ্ছে। তিনি জানান, মা যখন পবিত্র কাবা দেখলেন, কাঁদতে শুরু করলেন। বছরের পর বছর জমানো অর্থ ও আল্লাহ্র কাছে দোয়া এবার সার্থক হল। এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
মূলত ৯ যিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। এ দিনের নাম ইয়াইমুল আরাফা। ইসলামের বিধান মোতাবেক, ১০ যিলহজ মিনায় প্রত্যাবর্তনের পর হাজীদের পর্যায়ক্রমে চারটি কাজ সম্পন্ন করতে হয়। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহ্র উদ্দেশে পশু কুরবানি, মাথা মুণ্ডন করা এবং তাওয়াফে জিয়ারত। কাবা শরীফকে বিদায়ী তাওয়াফের মধ্য দিয়ে শেষ হয় হজের আনুষ্ঠানিকতা।