পুবের কলম, ওয়েবডেস্কঃ কাশ্মীরের নেতাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে বৈঠকে ডাকার পর থেকেই রাজনৈতিক জল্পনার পারদ তরতর করে চড়তে শুরু করেছিল। বারবার ‘চমক’দিতে সিদ্ধহস্ত প্রধানমন্ত্রী এবারও কী কাশ্মীর নিয়ে নতুন কোনও চমক দেবেন, সেই প্রশ্ন জোরালো হতে শুরু করে। ৩৭০ রদের পর এটাই কেন্দ্রের সঙ্গে উপত্যকার নেতাদের প্রথম বৈঠক। হাইভোল্টেজ এই বৈঠকের দিকে তাকিয়েছিল গোটা দেশ। বিশেষ করে কাশ্মীরিরা।
নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে দুর্দান্ত বাগ্মিতার মধ্য দিয়ে বৈঠককে এগিয়ে নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রী। শুরুতেই বলেন, ‘দিল্লি কি দূরি’এবং ‘দিল কি দূরি’ দূর করতে চান তিনি। আসলে প্রধানমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন কাশ্মীরের সঙ্গে দিল্লির ভৌগলিক দূরত্ব যেমন ঘুচিয়ে দিতে চান একইভাবে কাশ্মীরিদের সঙ্গে যে মনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে তাও মুছে দিতে চান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন কাশ্মীরির মৃত্যুও অত্যন্ত বেদনাদায়ক। তিনি চান, কাশ্মীরের সার্বিক উন্নয়ন। বৈঠকে উপস্থিত কাশ্মীরের নেতারাও বৈঠকে ‘সোজাসাপটা’ কথা বলেছেন বলে জানা গিয়েছে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে পিডিপি নেত্রী তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে এসেছেন– কাশ্মীরের মানুষ ভালো নেই। ৩৭০ রদ হওয়ার পর থেকে কাশ্মীরিদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভ, আক্রোশ তৈরি হয়েছে। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার ফলে কাশ্মীরিরা হীনম্মন্যতায় ভুগতে শুরু করেছে। মেহবুবা আরও বলেন, তিনি কাশ্মীরের মানুষের হয়ে এখানে কথা বলতে এসেছিলেন। কাশ্মীরের মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। মুখ খুললেই মিলিটারি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ইউএপিএ (বেআইনি কার্যকলাপ আইন) ধারায় কেস দেওয়া হচ্ছে। মানুষ শ্বাস নিতে পারছে না। একটু জোরে শ্বাস নিলেই ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছেন, ২০২০ সালের ৫ আগস্টের (৩৭০– ৩৫ এ প্রত্যাহার) পর থেকে কাশ্মীরিরা ভালো নেই। কাশ্মীরের মানুষ ৩৭০ অবলুপ্তির বিরুদ্ধে। যেভাবে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হয়েছে তা ‘অসাংবিধানিক’– ‘অনৈতিক’ও ‘বেআইনি’। যতদিন পর্যন্ত না ৩৭০ ফেরানো হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। জেলবন্দি যুবকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। মেহবুবা আরও বলেন, পাকিস্তান আমাদেরকে ৩৭০ দেয়নি। এটা দিয়েছেন জওহরলাল নেহরু ও সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা গুলাম নবি আজাদ বলেন– সদর্থক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আগে নির্বাচনী আসনগুলির সীমানা বিন্যাস (ডিলিমিটেশন) করা হবে– তারপর ভোট হবে। যদিও বিরোধীরা দাবি করেছেন আগে জম্মু-কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে, তারপর ভোটের কথা ভাবা যাবে।
আজাদ আরও বলেন, কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া রাজ্যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরানো সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, ডোমিসাইল চালু এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসন এই দাবিগুলিকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে রাখা হয়েছিল। বৈঠকে ন্যাশনাল কনফারেন্স সুপ্রিমো তথা জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ বলেন– জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের বিশ্বাস পুনরায় অর্জন করতে হলে অবশ্যই উপত্যকার রাজ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে হবে। এনসি নেতা ওমর আবদুল্লাহ বলেন, ৩৭০ রদের ফলে কেন্দ্র ও জম্মু-কাশ্মীরের মধ্যে যে বিশ্বাস ছিল তা ভেঙে গিয়েছে।
এ দিনের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন,’ সঠিক সময়ে’ই উপত্যকাকে তার রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী উপত্যকার নেতাদের বলেন, ডিলিমিটেশন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করার জন্য যাতে দ্রুত নির্বাচন করানো যায়।
প্রধানমন্ত্রীর কথায়, জম্মু-কাশ্মীরে তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্রকে মজবুত করাই আমাদের অগ্রাধিকার। ডিলিমিটেশন খুব দ্রুততার সঙ্গে করা হবে যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীর একটি নির্বাচিত সরকার পায় যা উপত্যকার উন্নয়নকে মজজবুত করবে।’
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টÉমন্ত্রী অমিত শাহ বলেন, ‘জম্মু-কাশ্মীর’ এর সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে আমরা প্রতশ্রুতিবদ্ধ। জম্মু-কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ কোন পথে তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ডিলিমিটেশন ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন উপত্যকাকে রাজ্যের মর্যাদা ফেরানোর ক্ষেত্রে ঠিক যে প্রতিশ্রুতি সংসদে দেওয়া হয়েছিল।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার কাশ্মীরের কাশ্মীরের প্রথম সারির ৮টি রাজনৈতিক দলের প্রথম সারির ১৪জন নেতা বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ফারুক আবদুল্লাহ, ওমর আবদুল্লাহ, মেহবুবা মুফতি– গুলাম নবি আজাদ ছাড়াও গুলাম আহমেদ মীর মুজাফফর হুসেন বেগ, আলতাফ বুখারি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রের তরফে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টÉ মন্ত্রী অমিত শাহ, জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল মনোজ সিনহা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল প্রমুখ।
রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, ইতিবাচক পরিবেশে বৈঠক হলেও প্রধানমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টÉমন্ত্রী কেউই নির্দিষ্ট করে বললেন না কবে জম্মু-কাশ্মীরকে তার পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কেন শুধু জম্মু-কাশ্মীরে ডিলিমিটেশন হবে তা নিয়ে কোনও উত্তর মেলেনি। একইভাবে উত্তর মেলেনি কবে ৩৭০ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া নিয়েও মেলেনি কোনও আশ্বাসবাণী।